পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২৬ 疊 রবীন্দ্র-রচনাবলী আকাশ যে মানুষের তৈরি জিনিস নয়, তাই লোকালয় পারতপক্ষে তাদের জন্যে জায়গা রাখতে চায় না— তাই আবখ্যক বাদে যেটুকু নিরালা থাকে সেটুকু অনাবশ্বক দিয়ে ঠেসে ভরতি করে দেয়। এমনি করে মানুষ আপনার দিনগুলোকে তো নিরেট করে তুলেইছে, রাত্রিটাকেও যতখানি পারে ভরাট করে দেয়। ঠিক যেন কলকাতার মুনিসিপ্যালিটির আইন। যেখানে যত পুকুর আছে বুজিয়ে ফেলতে হবে, রাবিশ দিয়ে হোক, যেমন করে হোক। এমন-কি, গঙ্গাকেও যতখানি পারা যায় পুল-চাপা, জেটি-চাপা, জাহাজচাপা দিয়ে গলা টিপে মারবার চেষ্টা । ছেলেবেলাকার কলকাতা মনে পড়ে ; ওই পুকুরগুলোই ছিল আকাশের স্যাঙাত, শহরের মধ্যে ওইখানটাতে দু্যলোক এই ভূলোকে একটুখানি পা ফেলবার জায়গা পেত, ওইখানেই আকাশের আলোকের আতিথ্য করবার জন্য পৃথিবী আপন জলের আসনগুলি পেতে রেখেছিল। আবশ্বকের একটা সুবিধা এই যে তার একটা সীমা আছে। সে সম্পূর্ণ বেতালা হতে পারে না ; সে দশটা-চারটেকে স্বীকার করে, তার পার্বণের ছুটি আছে, সে রবিবারকে মানে, পারতপক্ষে রাত্রিকে সে ইলেকটিক লাইট দিয়ে একেবারে হেসে উড়িয়ে দিতে চায় না। কেননা, সে যেটুকু সময় নেয় আয়ু দিয়ে, অর্থ দিয়ে তার দাম চুকিয়ে দিতে হয় ; সহজে কেউ তার অপব্যয় করতে পারে না । কিন্তু, অনাবশ্বকের তালমানের বোধ নেই ; সে সময়কে উড়িয়ে দেয় অসময়কে টিকতে দেয় না। সে সদর রাস্তা দিয়ে ঢোকে, থিরকির রাস্ত দিয়ে ঢোকে, আবার জানাল দিয়ে ঢুকে পড়ে। সে কাজের সময় দরজায় ঘা মারে, ছুটির সময় হুড় মুড়, করে আসে, রাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় । তার কাজ নেই ব’লেই তার ব্যস্ততা আরো বেশি । আবখ্যক কাজের পরিমাণ আছে, অনাবশ্যক কাজের পরিমাণ নেই ; এইজন্তে অপরিমেয়ের আসনটি ওই লক্ষ্মীছাড়াই জুড়ে বসে, ওকে ঠেলে ওঠানো দায় হয়। তখনই মনে হয়, দেশ ছেড়ে পালাই, সন্ন্যাসী হয়ে বেরই, সংসারে আর টেকা যায় না ! যাক, যেমনি বেরিয়ে পড়েছি অমনি বুঝতে পেরেছি, বিরাট বিশ্বের সঙ্গে আমাদের যে আনন্দের সম্বন্ধ সেটাকে দিনরাত অস্বীকার করে কোনো বাহাদুরি নেই। এই যে ঠেলাঠেলি ঠেসাঠেসি নেই অথচ সমস্ত কানায় কানায় ভরা, এইখানকার দর্পণটিতে যেন নিজের মুখের ছায়া দেখতে পেলুম। ‘আমি আছি' এই কথাটা গলির মধ্যে, ঘরবাড়ির মধ্যে ভারি ভেঙে চুরে বিকৃত হয়ে দেখা দেয়। এই কথাটাকে এই সমূত্রের উপর আকাশের উপর সম্পূর্ণ ছড়িয়ে দিয়ে দেখলে তবে তার মানে বুঝতে পারি ; তখন আবশ্বককে ছাড়িয়ে, অনাবশ্বককে পেরিয়ে আনন্দলোকে তার অভ্যর্থনা দেখতে পাই ; তখন স্পষ্ট করে বুঝি, ঋষি কেন মানুষদের অমৃতস্ত পুত্রা: ব’লে আহ্বান করেছিলেন।