পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি হারুন-মারু জাহাজ ২৪শে সেপ্টেম্বর ১৯২৪ সকাল আটটা । আকাশে ঘন মেঘ, দিগন্ত বৃষ্টিতে ঝাপসা, বাদলার হাওয়া খুতখুতে ছেলের মতো কিছুতেই শান্ত হতে চাচ্ছে না । বন্দরের শানবাধানো বাধের ওপারে দুরন্ত সমুদ্র লাফিয়ে লাফিয়ে গর্জে উঠছে, কাকে যেন কুটি ধরে পেড়ে ফেলতে চায়, নাগাল পায় না। স্বপ্নের আক্রোশে সমস্ত মনটা যেমন বুকের কাছে গুমরে ঠেলে ঠেলে উঠতে থাকে, আর রুদ্ধকণ্ঠের বদ্ধবাণী কান্না হয়ে হা হা করে ফেটে পড়তে চায়, ওই ফেনিয়ে-ওঠ বোবার গর্জন শুনে বৃষ্টিধারায়-পাণ্ডুবর্ণ সমুদ্রকে তেমনি বোধ হচ্ছে একটা অতলস্পর্শ অক্ষম ক্ষোভের দুঃস্বপ্ন । যাত্রার মুখে এইরকম দুর্যোগকে কুলক্ষণ বলে মনটা স্নান হয়ে যায়। আমাদের বুদ্ধিটা পাকা, সে একেলে, লক্ষণ-অলক্ষণ মানে না ; আমাদের রক্তটা কাচা, সে আদিমকালের— তার ভয়ভাবনাগুলো তর্কবিচারকে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে বোঁকে ওঠে, ওই পাথরের বেড়ার ওপারের অবুঝ ঢেউগুলোরই মতো। বুদ্ধি আপন যুক্তির কেল্লার মধ্যে বিশ্বপ্রকৃতির যতরকম ভাষাহীন আভাস-ইঙ্গিতের স্পর্শ থেকে সরে বসে থাকে। রক্ত থাকে আপন বুদ্ধির বেড়ার বাইরে ; তার উপর মেঘের ছায়া পড়ে, ঢেউয়ের দোলা লাগে ; বাতাসের বঁাশিতে তাকে নাচায়, আলো-আঁধারের ইশারা থেকে সে কত কী মানে বের করে ; আকাশে যখন অপ্রসন্নতা তখন তার আর শাস্তি নেই। অনেকবার দূরদেশে যাত্রা করেছি, মনের নোঙরটা তুলতে খুব বেশি টানাটানি করতে হয় নি। এবার সে কিছু যেন জোরে ডাঙা অঁাকড়ে আছে। তার থেকে বোধ হচ্ছে, এতদিন পরে আমার বয়স হয়েছে । না-চলতে চাওয়া প্রাণের কৃপণতা, সঞ্চয় কম হলে খরচ করতে সংকোচ হয় । তবু মনে জানি, ঘাটের থেকে কিছু দূরে গেলেই এই পিছুটানের বঁাধন খসে যাবে। তরুণ পথিক বেরিয়ে আসবে রাজপথে । এই তরুণ একদিন গান গেয়েছিল, “আমি