পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র রচনাবলী واریان) চঞ্চল হে, আমি স্থদ্বরের পিয়াসী।” আজই সেই গান কি উজান হাওয়ায় ফিরে গেল। সাগরপারে যে-অপরিচিত আছে তার অবগুণ্ঠন মোচন করবার জন্যে কি কোনো উৎকণ্ঠ নেই। কিছুদিন আগে চীন থেকে আমার কাছে নিমন্ত্রণ এসেছিল। সেখানকার লোকে আমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চেয়েছিল— কোনো পাকা কথা। অর্থাৎ, সে নিমন্ত্রণ প্রবীণকে নিমন্ত্রণ । দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এবার আমার নিমন্ত্রণ এল, তাদের শতবার্ষিক উৎসবে যোগ দেবার জন্যে। তাই হালকা হয়ে চলেছি, আমাকে প্রবীণ সাজতে হবে না । বক্তৃতা যত করি তার কুয়াশার মধ্যে আমি আপনি ঢাকা পড়ে যাই। সে তো আমার কবির পরিচয় নয় । গুটির থেকে প্রজাপতি বেরয় তার নিজের স্বভাবে । গুটির থেকে রেশমের স্বতো বেরতে থাকে বস্তুতত্ত্ববিদের টানাটানিতে। তখন থেকে প্রজাপতির অবস্থা শোকাবহ । আমার মাঝবয়স পেরিয়ে গেলে পর আমি আমেরিকার যুক্তরাজ্যে গেলুম ; সেখানে আমাকে ধরে-বেঁধে বক্তৃতা করালে, তবে ছাড়লে । তার পর থেকে হিতকথার আসরে আমার আনাগোনার আর অস্ত নেই। আমার কবির পরিচয়টা গৌণ হয়ে গেল । পঞ্চাশ বছর কাটিয়েছিলুম সংসারের বেদরকারি মহলে বেসরকারি ভাবে ; মহুর মতে যখন বনে যাবার সময় তখন হাজির হতে হল দরকারের দরবারে । সভা সমিতি আমার কাছে সরকারি কাজ আদায় করতে লেগে গেল। এতেই বোধ হচ্ছে, আমার শনির দশা । কবি হন বা কলালিং হন তারা লোকের ফরমাশ টেনে আনেন— রাজার ফরমাশ, প্রভূর ফরমাশ, বহুপ্রভূর সমাবেশরপী সাধারণের ফরমাশ । ফরমাশের আক্রমণ থেকে র্তাদের সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি নেই। তার একটা কারণ, অন্দরে তারা মানেন সরস্বতীকে, সদরে র্তাদের মেনে চলতে হয় লক্ষ্মীকে । সরস্বতী ডাক দেন অমৃতভাণ্ডারে, লক্ষ্মী ডাক দেন অন্নের ভাণ্ডারে । শ্বেতপদ্মের অমরাবতী আর সোনার পদ্মের অলকাপুরী ঠিক পাশাপাশি নেই। উভয়ত্রই যাদের ট্যাক্সো দিতে হয়, এক জায়গায় খুশি হয়ে, আরেক জায়গায় দায়ে পড়ে, তাদের বড়ো মুশকিল। জীবিকা অর্জনের দিকে সময় দিলে ভিতরমহলের কাজ চলে না । যেখানে ট্রামের লাইন বসাতে হবে সেখানে ফুলের বাগানের আশা করা মিথ্যে। এই কারণে ফুলবাগানের সঙ্গে আপিসের রাস্তার একটি আপস হয়েছে এই যে, মালি জোগাবে ফুল আর ট্রামলাইনের মালেক জোগাবে অন্ন । দুর্ভাগ্যক্রমে ঘে-মানুষ অন্ন জোগায় মর্তলোকে তার প্রতাপ বেশি। কারণ, ফুলের শখ পেটের জালার সঙ্গে জবরদস্তিতে সমকক্ষ নয়।