পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী '93) নেই, তার কালো কালো ক্ষতগুলোর উপরে পর্দা নেই, আমিও হব তেমনি । এতদিন ষাকে বলে এসেছি লজ্জা, যাকে বলে এসেছি শ্ৰী, আজ তাতে আমার পরাভব ঘটছে ; সে সব বাধা বর্জন করব । পুরুষের চালে তার সমান তালে পা ফেলে তার সমান রাস্তায় চলব।” এমন কথা যে একদল স্ত্রীলোকের মুখ দিয়ে বের হল, এটা সম্ভব হল কী করে। এতে বোঝা যায়, পুরুষের প্রকৃতির মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। মেয়েকে সে চাচ্ছে না। এমন নয় যে সে হঠাৎ সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছে ; ঠিক তার উলটো— সে হয়েছে বিষয়ী ; মেয়েকে সে কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিতে চায় ; কড়ায় গণ্ডায় যার হিসাব মেলে না তাকে সে মনে করে বাজে জিনিস, তাকে সে মনে করে ঠকা । সে বলে, “আমি চোখ খুলে সব স্পষ্ট করে তন্ন তন্ন করে দেখব।” অর্থাৎ, ধ্যানের দেখায় যা মনকে ভরিয়ে তোলে সেটাকে সে জানে ফাকি । কিন্তু, পুরুষের সংসারে সত্যকার মেয়ে তো কেবলমাত্র চোখের দেখার নয়, সে তো ধ্যানের জিনিসও বটে। সে যে শরীরী অশরীরী দু’য়ে মিলিয়ে, পৃথিবী যেমন নিজের মাটি ধুলো এবং নিজের চার দিকের অসীম আকাশ ও বায়ুমণ্ডল মিলিয়ে । মেয়ের যা অশরীরী তা যে শরীরী মেয়েকে ঘিরে আছে ; তার ওজন নেই, কিন্তু তার বর্ণ আছে, ভঙ্গী আছে ; তা ঢাকে অথচ তা প্রকাশ করে । পাশ্চাত্য সভ্যতায় যার উন্নতির বড়াই করে, তারা বলবে, এই মেয়েলির প্রতি অসহিষ্ণুতায় চলার উৎসাহ প্রকাশ পায়। আমার মনে হয়, এটাই থামবার পূর্বলক্ষণ । চলার ছন্দই থাকে না যদি স্থিতির সঙ্গে তার সমস্ত আপস একেবারে মিটে ষায় । গাড়িটার ঘোড়াও চলছে, সারথিও চলছে, যাত্রীরাও চলছে, গাড়ির জোড় খুলে গিয়ে তার অংশপ্রত্যংশগুলোও চলছে, একে তো চলা বলে না ; এ হচ্ছে মরণোন্মুখ চলার উন্মত্ত প্ৰলাপ, সাংঘাতিক থামার ভূমিকা । মেয়ের সমাজের চলাকেই স্থিতির ছন্দ দেয়— সে ছন্দ সুন্দর। একদল মেয়ে বলতে শুরু করেছে যে, “মেয়ে হওয়াতে আমাদের অগৌরব, আমাদের ক্ষতি । অর্থাৎ, আমাদের আত্মপ্রকাশের ধারায় পুরুষের সঙ্গে প্রভেদটাতে পীড়া পাচ্ছি।” এর থেকে বোধ হচ্ছে, একদিন যে পুরুষ সাধক ছিল এখন সে হয়েছে বণিক। বণিক বাইরের দিকে যদিবা চলে, অস্তরের দিকে আপনার সঞ্চয়ের বোঝার কাছে সতর্ক হয়ে পড়ে আছে । তার স্থিতি সারবান কিন্তু স্বন্দর নয়। তার কারণ, মানুষের সম্বন্ধকে হৃদয়মাধুর্যে সত্য ক’রে পূর্ণ ক’রে তোলা তার স্থিতির ধর্ম নয় ; ধনসঞ্চয়ের তলায় মানুষের সম্বন্ধকে চাপা দিয়ে চ্যাপটা করে দেওয়াই হয়েছে তার কাজ। স্বতরাং, সে ষে কেবল চলে না তা নয়, আপন স্থিতিকে ভারগ্রস্ত নীরস নির্মম