পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 ᎼᏔa রবীন্দ্র-রচনাবলী । তাই দেখেছি, খোলা রাস্তার বঁশিতে হঠাৎ-হাওয়ায় ষে গান বনের মর্মরে নদীর কলোলের সঙ্গে সঙ্গে বেজেছে, যে-গান ভোরের শুকতারার পিছে পিছে অরুণ-আলোর পথ দিয়ে চলে গেল, শহরের দরবারে ঝাড়লন্ঠনের আলোতে তারা ঠাই পেল না ; ওস্তাদের বললে “এ কিছুই না”, প্রবীণেরা বললে এর মানে নেই” ! কিছু নয়ই তো বটে ; কোনো মানে নেই, সে-কথা খাটি ; সোনার মতো নিকষে কষা যায় না, পাটের বস্তার মতো দাড়িপাল্লায় ওজন চলে না। কিন্তু, বৈরাগী জানে, অধর রসেই ওর রস । কতবার ভাবি গান তো এসেছে গলায় কিন্তু শোনাবার লগ্ন রচনা করতে তো পারি নে ; কান যদি-বা খোলা থাকে আনমনার মন পাওয়া যাবে কোথায়। সে-মন যদি তার গদি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারে তবেই-তে যা বলা যায় না তাই সে শুনবে, যা জানা স্বায় না তাই সে বুঝবে। ক্রাকোভিয়া জাহাজ ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ জন্মকাল থেকে আমাকে একখানা নির্জন নিঃসঙ্গতার ভেলার মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তীরে দেখতে পাচ্ছি লোকালয়ের আলো, জনতার কোলাহল ; ক্ষণে ক্ষণে ঘাটেও নামতে হয়েছে, কিন্তু কোনোখানে জমিয়ে বসতে পারি নি। বন্ধুরা ভাবে তাদের এড়িয়ে গেলুম ; শত্রুরা ভাবে, অহংকারেই দূরে দূরে থাকি। ষে-ভাগ্যদেবতা বরাবর আমাকে সরিয়ে সরিয়ে নিয়ে গেল, পাল গোটাতে সময় দিলে না, রশি যতবার ভাঙার খোটায় বেঁধেছি টান মেরে ছিড়ে দিয়েছে, সে কোনো কৈফিয়ত দিলে না । সুখদু:খের হিসাবনিকাশ নিয়ে ভাগ্যের সঙ্গে তকরার করে লাভ নেই। যা হয়েছে তার একটা হেতু আছে, সেই হেতুর উপর রাগ করলে হাওয়ার উপরেই রাগতে হয়। ঘড়া রাগ করে ঠং ঠং শব্দে যদি বলে “আমাকে শূন্ত করে গড়েছে কেন", তার জবাব হচ্ছে, “তোমাকে শূন্ত করবে বলেই ঘড়া করে নি, ঘড়া করবে বলেই শূন্ত করেছে।” ঘড়ার শূন্তত পূর্ণতারই অপেক্ষায়। আমার একলা-আকাশের ফাকটাকে ভরতি করতে হবে, সেই প্রত্যাশাটা আমার সঙ্গে সঙ্গে লেগে আছে । দৈবের এই দাবিটিই আমার সম্মান ; একে রক্ষা করতে হলে পুরাপুরি দাম দিতে হবে। তাই শূন্ত আকাশে একলা বসে ভাগ্যনির্দিষ্ট কাজ করে থাকি। তাতেই আমার হওয়ার অর্থটা বুঝি, কাজেই আনন্দও পাই। বঁশির ফাকটা যখন স্বরে ভরে ওঠে তখন তার আর-কোনো নালিশ থাকে না । শরীরে মনে প্রাণের দক্ষিণ হাওয়া যখন জোরে বয় তখন আত্মপ্রকাশের দক্ষিণ্যেই