পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 o রবীন্দ্র-রচনাবলী স্বদীর্ঘকাল মানুষের সজীব চিত্তের সিংহাসনে বসে যিনি অসংখ্য নরনারীর ভক্তিপ্রেমের অর্ঘ্যে অলংকৃত হয়েছেন তিনি চিরকালের বুদ্ধ। তার ছবি সুদীর্ঘ যুগযুগাস্তরের পটে আঁকা হয়েই চলেছে। র্তার সত্য কেবলমাত্র তাকে নিয়ে নয়, তার সত্য বহু দেশকালপাত্রের বিপুলতাকে নিয়ে ; সেই বৃহৎ পরিমণ্ডলের মধ্যে তার দৈনিক ঘটনা, তার সাময়িক মানসিক অবস্থার চঞ্চল ছায়ালোকপাত চোখে দেখতেই পাওয়া যাবে না । যদি কোনো অণুবীক্ষণ নিয়ে সেইগুলোকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখি তা হলে তার বৃহৎ রূপটাকে দেখা অসম্ভব হবে । ষে-মানুষ আপন সাধারণ-ব্যক্তিগত পরিধির মধ্যে বিশেষ দিনে জন্মলাভ করে বিশেষ দিনে মরে গেছেন তিনি বুদ্ধই নন। মানুষের ইতিহাস সেই আপন বিস্মরণশক্তির গুণেই সেই ছোটো বুদ্ধের প্রতিদিনের ছোটো ছোটো ব্যাপার ভুলে যেতে পেরেছে, তবেই একটি বড়ো বুদ্ধকে পেয়েছে। মানুষের স্মরণশক্তি যদি ফোটোগ্রাফের প্লেটের মতো সম্পূর্ণ নির্বিকার হত তা হলে সে আপন ইতিহাস থেকে উদ্ধৃবৃত্তি করে মরত, বড়ো জিনিস থেকে বঞ্চিত হত। বড়ো জিনিস যেহেতু দীর্ঘকাল থাকে এইজন্তে তাকে নিয়ে মানুষ অকর্মকভাবে থাকতেই পারে না। তাকে নিজের স্বষ্টিশক্তি নিজের কল্পনাশক্তি দিয়ে নিয়তই প্রাণ জুগিয়ে চলতে হয়। কেননা, বড়ো জিনিসের সঙ্গে তার-যে প্রাণের যোগ, কেবলমাত্র জ্ঞানের যোগ নয়। এই যোগের পথ দিয়ে মাস্থ্য আপন প্রাণের মাতুষদের কাছ থেকে যেমন প্রাণ পায় তেমনি তাদের প্রাণ দেয়। এই প্রসঙ্গে একটি অপেক্ষাকৃত ছোটো দৃষ্টান্ত আমার মনে পড়ছে। ম্যাক্সিম গোকি টলস্টয়ের একটি জীবনচরিত লিখেছেন। বর্তমানকালের প্রখরবুদ্ধি পাঠকেরা বাহবা দিয়ে বলছেন, এ-লেখাটা আর্টিস্টের যোগ্য লেখা বটে। অর্থাৎ, টলস্টয় দোষে গুণে ঠিক যেমনটি সেই ছবিতে তীক্ষু রেখায় তেমনটি আঁকা হয়েছে ; এর মধ্যে দয়ামায়া ভক্তিশ্রদ্ধার কোনো কুয়াশ নেই। পড়লে মনে হয়, টলস্টয় যে সর্বসাধারণের চেয়ে বিশেষ কিছু বড়ে তা নয়, এমন-কি, অনেক বিষয়ে হেয় । এখানে আবার সেই কথাটাই আসছে। টলস্টয়ের কিছুই মন্দ ছিল না, এ কথা বলাই চলে না ; খুটিনাটি বিচার করলে তিনি-ষে নানা বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতোই এবং অনেক বিষয়ে তাদের চেয়েও দুর্বল, এ কথা স্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু, যে-সত্যের গুণে টলস্টয় বহুলোকের এবং বহুকালের, তার ক্ষণিকমূতি যদি সেই সত্যকে আমাদের কাছ থেকে, আচ্ছন্ন করে থাকে তা হলে এই আর্টিস্টের আশ্চর্য ছবি নিয়ে আমার লাভ হবে কী । প্রথম যখন আমি দাৰ্জিলিং দেখতে গিয়েছিলুম দিনের পর দিন কেবলই দেখেছিলুম মেঘ আর কুয়াশা। কিন্তু জানা ছিল, এগুলো সাময়িক এবং যদিও হিমালয়কে আচ্ছন্ন