পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 88:S জন্যেই যে, গোলাপ ফুলের দিকে আমার মন যেমন করে চেয়ে দেখে ইটের ঢেলার দিকে তেমন করে চায় না । গোলাপফুল আমার কাছে তার ছন্দের রূপে সহজেই সত্তারহস্তের কী একটা নিবিড় পরিচয় দেয়। সে কোনো বাধা দেয় না। প্রতিদিন হাজার জিনিসকে বা না বলি, তাকে তাই বলি ; বলি, “তুমি আছ।” একদিন আমার মালী ফুলদানি থেকে বাসি ফুল ফেলে দেবার জন্তে যখন হাত বাড়ালো, বৈষ্ণবী তখন ব্যথিত হয়ে বলে উঠল, “লিখতে পড়তেই তোমার সমস্ত মন লেগে আছে, তুমি তো দেখতে পাও না ।” তখনই চমকে উঠে আমার মনে পড়ে গেল, স্থা, তাই তো বটে। ওই ‘বাসি’ বলে একটা অভ্যন্ত কথার আড়ালে ফুলের সত্যকে আর আমি সম্পূর্ণ দেখতে পাই নে। যে আছে সেও আমার কাছে নেই ; নিতান্তই অকারণে, সত্য থেকে, স্থতরাং আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলুম। বৈষ্ণবী সেই বাসি ফুলগুলিকে অঞ্চলের মধ্যে সংগ্রহ করে তাদের চুম্বন করে নিয়ে চলে গেল । আর্টিস্ট তেমনি করে আমাদের চমক লাগিয়ে দিক। তার ছবি বিশ্বের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দিয়ে বলুক, “ওই দেখো, আছে।” সুন্দর বলেই আছে তা নয়, আছে বলেই সুন্দর । সত্তাকে সকলের চেয়ে অব্যবহিত ও সুস্পষ্ট করে অনুভব করি আমার নিজের মধ্যে । “আছি” এই ধ্বনিটি নিয়তই আমার মধ্যে বাজছে । তেমনি স্পষ্ট করে যেখানেই আমরা বলতে পারি “আছে” সেখানেই তার সঙ্গে, কেবল আমার ব্যবহারের অগভীর মিল নয়, আত্মার গভীরতম মিল হয় । “আছি” অনুভূতিতে আমার যে-আনন্দ, তার মানে এ নয় যে, আমি মাসে হাজার টাকা রোজগার করি বা হাজার লোকে আমাকে বাহবা দেয়। তার মানে হচ্ছে এই যে, আমি যে সত্য এটা আমার কাছে নি:সংশয়, তর্ক করা সিদ্ধান্তের দ্বারা নয়, নিবিচার একান্ত উপলব্ধির দ্বারা । বিশ্বে যেখানে তেমনি একান্তভাবে “আছে” এই উপলব্ধি করি সেখানে আমার সত্তার আনন্দ বিস্তীর্ণ হয়। সত্যের ঐক্যকে সেখানে ব্যাপক করে জানি । কোনো ফরাসি দার্শনিক অসীমের তিনটি ভাব নির্ণয় করেছেন— the True, the Good, the Beautiful । ব্রাহ্মসমাজে তারই একটি সংস্কৃত তর্জমা খুব চলতি হয়েছে— সত্যং শিবং মুন্দরম। এমন-কি, অনেকে মনে করেন, এটি উপনিষদের বাণী । উপনিষৎ সত্যের স্বরূপ যে ব্যাখ্যা করেছেন সে হচ্ছে, শাস্তং শিবং অদ্বৈতম্। শান্তং হচ্ছে সেই সামঞ্জস্য যার যোগে সমস্ত গ্ৰহতারা নিয়ে বিশ্ব শাস্তিতে বিধৃত, যার যোগে কালের গতি চিরন্তন ধুতির মধ্যে নিয়মিত : নিমেষ মুহূর্তাণ্যর্ধমাস ঋতব সংবৎসর ইতি বিধৃতাস্তিষ্ঠন্তি — শিবং হচ্ছে মানবসমাজের মধ্যে সেই সামঞ্জস্য যা নিয়তই