পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8Ꮰa এতে মিথ্যা। বিশ্বকৰ্মার বঁশিতে নিয়তই যে ছুটির স্বর বাজে এই কারণেই সেটা শুনতে পাই নে ; সেই ছুটির স্বরেই বিশ্বকাজের ছন্দ বাধা । সেই স্বরটি আজ সকালের আলোতে ওই নারকেলগাছের তানপুরায় বাজছে। ওখানে দেখতে পাচ্ছি, শক্তির রূপ আর মুক্তির রূপ অনবচ্ছিন্ন এক। এতেই শাস্তি, এতেই সৌন্দর্য । জীবনের মধ্যে এই মিলনটিই তো খুজি— করার চিরবহমান নদীধারায় আর হওয়ার চিরগষ্ঠীর মহাসমূত্রে মিলন। এই আত্মপরিতৃপ্ত মিলনটিকে লক্ষ্য করেই গীত বলেছেন, “কৰ্ম করে, ফল চেয়ে না।” এই চাওয়ার রাহুটাই কর্মের পাত্র থেকে তার অমৃত ঢেলে নেবার জন্তে লালায়িত। ভিতরকার সহজ হওয়াটি সার্থক হয় বাইরেকার সহজ কর্মে। অন্তরের সেই সার্থকতার চেয়ে বাইরের স্বার্থ প্রবল হয়ে উঠলেই কর্ম হয় বন্ধন ; সেই বন্ধনেই জড়িত যত হিংসা দ্বেষ ঈর্ষা, নিজেকে ও অন্তকে প্রবঞ্চনা । এই কর্মের দুঃখ, কর্মের অগৌরব, যখন অসহ্য হয়ে ওঠে তখন মানুষ বলে বসে “দূর হোক গে, কর্ম ছেড়ে দিয়ে চলে যাই ।” তখন আবার আহবান আসে, কর্ম ছেড়ে দিয়ে কর্ম থকে নিষ্কৃতি নেই ; করাতেই হওয়ার আত্মপ্রকাশ। বাহ ফলের দ্বারা নয়, আপন অস্তনিহিত সত্যের দ্বারাই কর্ম সার্থক হোক, তাতেই হোক মুক্তি। ফল-চাওয়া কর্মের নাম চাকরি, সেই চাকরির মনিব আমি নিজেই হই বা অন্তেই হোক। চাকরিতে মাইনের জন্যেই কাজ, কাজের জন্যে কাজ নয়। কাজ তার নিজের ভিতর থেকে নিজে যখন কিছুই রস জোগায় না, সম্পূর্ণ বাইরে থেকেই যখন আপন দাম নেয়, তখনই মানুষকে সে অপমান করে। মর্তলোকে প্রয়োজন বলে জিনিসটাকে একেবারেই অস্বীকার করতে পারি নে। বেঁচে থাকবার জন্তে আহার করতেই হবে। বলতে পারব না, “নেই বা করলেম ।” সেই আবশ্বকের তাড়াতেই পরের দ্বারে মানুষ উমেদারি করে, আর সেই সঙ্গেই তত্ত্বজ্ঞানী ভাবতে থাকে কী করলে এই কর্মের জড় মারা যায়। বিদ্রোহী মানুষ বলে বসে, বৈরাগ্যমেবাভয়ম। অর্থাৎ, এতই কম খাব, কম পরব, রৌপ্রবৃষ্টি এমন করে সহ করতে শিখব, দাসত্বে প্রবৃত্ত করবার জন্যে প্রকৃতি আমাদের জন্যে যতরকম কানমলার ব্যবস্থা করেছে সেগুলোকে এতটা এড়িয়ে চলব যে, কর্মের দায় অত্যন্ত হালকা হয়ে যাবে। কিন্তু, প্রকৃতির কাজে শুধু কানমলার তাড়া নেই, সেই সঙ্গে রসের জোগান আছে। এক দিকে ক্ষুধায় দেয় দুঃখ, আর-এক দিকে রসনায় দেয় স্থখ— প্রকৃতি একই সঙ্গে ভয় দেখিয়ে আর লোভ দেখিয়ে আমাদের কাজ করায় । সেই লোভের দিক থেকে আমাদের মনে জন্মায় ভোগের ইচ্ছা । বিদ্রোহী মানুষ বলে, ওই ভোগের ইচ্ছাটা প্রকৃতির চাতুরী, ওইটেই মোহ, ওটাকে তাড়াও, বলো, বৈরাগ্যমেবাভয়স্থ- মানব না দুঃখ, চাইব না স্বখ।