পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী Q&> প্রবাহ ধরেই ধর্মের শ্রেষ্ঠ আদর্শ বুদ্ধের মধ্যে অভিব্যক্ত । অতি সামান্ত জন্তুর ভিতরেও অতি সামান্ত রূপেই এই ভালোর শক্তি মন্দর ভিতর দিয়ে নিজেকে ফুটিয়ে তুলছে ; তার চরম বিকাশ হচ্ছে অপরিমেয় মৈত্রীর শক্তিতে আত্মত্যাগ। জীবে জীবে লোকে লোকে সেই অসীম মৈত্রী অল্প অল্প করে নানা দিক থেকে আপন গ্রন্থি মোচন করছে, সেই দিকেই মোক্ষের গতি। জীব মুক্ত নয় কেননা, আপনার দিকেই তার টান ; সমস্ত প্রাণীকে নিয়ে ধর্মের ষে অভিব্যক্তি তার প্রণালীপরম্পরায় সেই আপনার দিকে টানের পরে আঘাত লাগছে। সেই আঘাত যে-পরিমাণে যেখানেই দেখা যায় সেই পরিমাণে সেখানেই বুদ্ধের প্রকাশ। মনে আছে, ছেলেবেলায় দেখেছিলুম, দড়িতে বাধা ধোপার বাড়ির গাধার কাছে এসে একটি গাভী স্নিগ্ধচক্ষে তার গা চেটে দিচ্ছে ; দেখে আমার বড়ো বিস্ময় লেগেছিল। বুদ্ধই-ষে তার কোনো এক জন্মে সেই গাভী হতে পারেন, এ কথা বলতে জাতককথা-লেখকের একটুও বাধত না কেননা, গাভীর এই স্নেহেরই শেষ গিয়ে পৌচেছে মুক্তির মধ্যে। জাতককথায় অসংখ্য সামান্তের মধ্যে দিয়েই চরম অসামান্তকে স্বীকার করেছে। এতেই সামান্য এত বড়ো হয়ে উঠল। সেই জন্তেই এতবড়ো মন্দিরভিত্তির গায়ে গায়ে তুচ্ছ জীবনের বিবরণ এমন সরল ও নির্মল শ্রদ্ধার সঙ্গে চিত্রিত । ধর্মেরই প্রকাশচেষ্টার আলোতে সমস্ত প্রাণীর ইতিহাস বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে মহিমান্বিত । দুজন ওলন্দাজ পণ্ডিত সমস্ত ভালো করে ব্যাখ্যা করবার জন্তে আমাদের সঙ্গে ছিলেন । তাদের চরিত্রে পাণ্ডিত্যের সঙ্গে সরল হৃদ্যতার সম্মিলন আমার কাছে বড়ো ভালো লাগল। সব চেয়ে শ্রদ্ধা হয় এদের নিষ্ঠা দেখে । বোবা পাথরগুলোর মুখ থেকে কথা বের করবার জন্তে সমস্ত আয়ু দিয়েছেন । এদের মধ্যে পাণ্ডিত্যের কৃপণতা লেশমাত্র নেই– অজস্র দাক্ষিণ্য। ভারতবর্ষের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ করে জেনে নেবার জন্তে এদেরই গুরু বলে মেনে নিতে হবে । জ্ঞানের প্রতি বিশুদ্ধ নিষ্ঠা থেকেই এদের এই অধ্যবসায় । ভারতের বিদ্যা, ভারতের ইতিহাস, এদের নিকটের জিনিস নয়, অথচ এইটেই এদের সমস্ত জীবনের সাধনার জিনিস। আরো কয়েকজন পণ্ডিতকে দেখেছি ; তাদের মধ্যেও সহজ নম্রতা দেখে আমার মন আকৃষ্ট হয়েছে। ইতি ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৭১ • গ্ৰীমতী মীরা দেবীকে লিখিত । >○|○8