পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ XSE এক অভাবনীয় সম্মান লাভ করিলাম। বক্সাওনের গোলামকাদের খার পুত্রী হরউল্লীলা বা মেহেরউল্লীলা বা হর-উলমূলক আমাকে দাৰ্জিলিঙে ক্যালকাটা রোডের ধারে তাহার অনতিদূরবর্তী অনতি-উচ্চ পন্ধিল আসনে বসিবার অধিকার দিয়াছেন। হোটেল হইতে ম্যাকিন্টশ পরিয়া বাহির হইবার সময় এমন স্বমহৎ সম্ভাবনা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল । হিমালয়বক্ষে শিলাতলে একাস্তে দুইটি পান্থ নরনারীর রহস্তালাপকাহিনী সহসা সদ্যসম্পূর্ণ কবোষ্ণ কাব্যকথার মতো শুনিতে হয়, পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে দূরাগত নির্জন গিরিকন্দরের নির্বরপ্রপাতধ্বনি এবং কালিদাসরচিত মেঘদূত-কুমারসম্ভবের বিচিত্র সংগীতমৰ্মর জাগ্রত হইয়া উঠিতে থাকে, তথাপি এ কথা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে যে, বুট এবং ম্যাকিন্টশ পরিয়া ক্যালকাটা রোডের ধারে কর্দমাসনে এক দীনবেশিনী হিন্দুস্থানী রমণীর সহিত একত্র উপবেশনপূর্বক সম্পূর্ণ আত্মগৌরব অক্ষুন্নভাবে অনুভব করিতে পারে, এমন নব্যবঙ্গ অতি অল্পই আছে। কিন্তু সেদিন ঘনঘোর বাম্পে দশ দিক আবৃত ছিল, সংসারের নিকট চক্ষুলজা রাখিবার কোনো বিষয় কোথাও ছিল না, কেবল অনন্ত মেঘরাজ্যের মধ্যে বন্দ্রাওনের নবাব গোলামকাদের খার পুত্রী এবং আমি, এক নববিকশিত বাঙালী সাহেব— দুইজনে ছুইখানি প্রস্তরের উপর বিশ্বজগতের দুইখও প্রলয়াবশেষের ন্যায় অবশিষ্ট ছিলাম, এই বিসদৃশ সম্মিলনের পরম পরিহাস কেবল আমাদের অদৃষ্টের গোচর ছিল, কাহারে দৃষ্টিগোচর ছিল না। আমি কহিলাম, "বিবিলাহেব, তোমার এ হাল কে করিল।” বন্দ্ৰাওনকুমারী কপালে করাঘাত করিলেন কহিলেন, “কে সমস্ত করায় তা আমি কি জানি! এতবড়ো প্রস্তরময় কঠিন হিমালয়কে কে সামান্ত বাম্পের মেঘে অন্তরাল করিয়াছে।” আমি কোনোরূপ দার্শনিক তর্ক না তুলিয়া সমস্ত স্বীকার করিয়া লইলাম ; কহিলাম, “তা বটে, অদৃষ্টের রহস্ত কে জানে! আমরা তো কীটমাত্র ।” তর্ক তুলিতাম, বিবিলাহেবকে আমি এত সহজে নিষ্কৃতি দিতাম না কিন্তু আমার ভাষায় কুলাইত না। দরোয়ান এবং বেহারাদের সংসর্গে যেটুকু হিন্দি অভ্যস্ত হইয়াছে তাহাতে ক্যালকাটা রোডের ধারে বলিয়া বজাওনের অথবা অন্ত কোনো স্থানের কোনো নবাবপুত্রীর সহিত অদৃষ্টবাদ ও স্বাধীন ইচ্ছাবাদ সম্বন্ধে স্থম্পষ্টভাবে আলোচনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব হইত। বিবিলাহেব কহিলেন, “আমার জীবনের আশ্চৰ কাহিনী অন্তই পরিসমাপ্ত হইয়াছে, যদি ফরমায়েশ করেন তো বলি।” 啤