পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ఏవ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি শশব্যস্ত হইয়া কহিলাম, “বিলক্ষণ ! ফরমায়েশ কিসের । যদি অনুগ্রহ করেন তো শুনিয়া শ্রবণ সার্থক হইবে।” কেহ না মনে করেন, আমি ঠিক এই কথাগুলি এমনিভাবে হিন্দুস্থানি ভাষায় বলিয়াছিলাম, বলিবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু সামর্থ্য ছিল না । বিবিলাহেব যখন কথা কহিতেছিলেন আমার মনে হইতেছিল, যেন শিশিরক্ষাত স্বর্ণশীর্ষ স্নিগ্ধশ্বামল শস্তক্ষেত্রের উপর দিয়া প্রভাতের মন্দমধুর বায়ু হিল্লোলিত হইয়া যাইতেছে, তাহার পদে পদে এমন সহজ নম্রতা, এমন সৌন্দর্য, এমন বাক্যের অবারিত প্রবাহ। আর আমি অতি সংক্ষেপে খণ্ড খণ্ড ভাবে বর্বরের মতো সোজা সোজা উত্তর দিতেছিলাম । ভাষায় সেরূপ স্বসম্পূর্ণ অবিচ্ছিন্ন সহজ শিষ্টতা আমার কোনোকালে জানা ছিল না ; বিবিলাহেবের সহিত কথা কহিবার সময় এই প্রথম নিজের আচরণের দীনতা পদে পদে অনুভব করিতে লাগিলাম । তিনি কহিলেন, “আমার পিতৃকুলে দিল্লির সম্রাটবংশের রক্ত প্রবাহিত ছিল, সেই কুলগর্ব রক্ষণ করিতে গিয়া আমার উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পাওয়া দুঃসাধ্য হইয়াছিল। লক্ষেীয়ের নবাবের সহিত আমার সম্বন্ধের প্রস্তাব আসিয়াছিল, পিতা ইতস্তত করিতেছিলেন, এমন সময় দণতে টোটা কাটা লইয়া সিপাহিলোকের সহিত সরকারবাহাদুরের লড়াই বাধিল, কামানের ধোয়ায় হিন্দুস্থান অন্ধকার হইয়া গেল।” স্ত্রীকণ্ঠে, বিশেষত সম্রাস্ত মহিলার মুখে হিন্দুস্থানি কখনো শুনি নাই, শুনিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম, এ ভাষা আমিরের ভাষা— এ যে-দিনের ভাষা সে-দিন আর নাই, আজ রেলোয়ে টেলিগ্রাফে, কাজের ভিড়ে, আভিজাত্যের বিলোপে সমস্তই যেন হ্রস্ব খর্ব নিরলংকার হইয়া গেছে। নবাবজাদীর ভাষামাত্র শুনিয়া সেই ইংরাজরচিত আধুনিক শৈলনগরী দাৰ্জিলিঙের ঘনকুস্কটিকাজালের মধ্যে আমার মনশ্চক্ষের সম্মুখে মোঘলসম্রাটের মানসপুরী মায়াবলে জাগিয়া উঠিতে লাগিল— শ্বেতপ্রস্তররচিত বড়ো বড়ো অভ্ৰভেদী সৌধশ্রেণী, পথে লম্বপুচ্ছ অশ্বপৃষ্ঠে মছলন্দের সাজ, হস্তীপৃষ্ঠে স্বর্ণঝালরখচিত হাওদা, পুরবাসিগণের মস্তকে বিচিত্রবর্ণের উষ্ণৗষ, শালের রেশমের মসলিনের প্রচুরপ্রসর জামা পায়জামা, কোমরবন্ধে বক্র তরবারি, জরির জুতার অগ্রভাগে বক্র শীর্ষ— স্বদীর্ঘ অবসর, স্বলম্ব পরিচ্ছদ, স্বপ্রচুর শিষ্টাচার। নবাবপুত্ৰী কছিলেন, “আমাদের কেল্লা যমুনার তীরে । আমাদের ফৌজের অধিনায়ক ছিল একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ। তাহার নাম ছিল কেশরলাল ।” রমণী এই কেশরলাল শব্দটির উপর তাহার নারীকণ্ঠের সমস্ত সংগীত যেন একেবারে এক মুহূর্তে উপুড় করিয়া ঢালিয়া দিল । আমি ছড়িটা ভূমিতে রাখিয়া নড়িয়া-চড়িয়া খাড়া হইয়া বসিলাম । 瞬