পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SSb রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়া দিয়া বারম্বার তাহার পদধূলি মুছিয়া লইলাম, আমার উত্তপ্ত ললাটে তাহার হিমশীতল পাদপদ্ম তুলিয়া লইলাম, তাহার চরণ চুম্বন করিবামাত্র বহুদিবসের নিরুদ্ধ অশ্রুরাশি উচ্ছ্বসিত উজবেলিত হইয়া উঠিল। এমন সময়ে কেশরলালের দেহ বিচলিত হইল, এবং সহসা তাহার মুখ হইতে বেদনার অফুট আর্তম্বর শুনিয়া আমি তাহার চরণতল ছাড়িয়া চমকিয়া উঠিলাম ; শুনিলাম নিমৗলিত নেত্রে শুষ্ক কণ্ঠে একবার বলিলেন 'জল’ । আমি তৎক্ষণাৎ আমার গাত্রবস্ত্র যমুনার জলে ভিজাইয়া ছুটিয়া চলিয়া আসিলাম । বসন নিংড়াইয়া কেশরলালের আমীলিত ওষ্ঠাধরের মধ্যে জল দিতে লাগিলাম, এবং বামচক্ষু নষ্ট করিয়া তাহার কপালে যে নিদারুণ আঘাত লাগিয়াছিল সেই আহত স্থানে আমার সিক্ত বসনপ্রাস্ত ছিড়িয়া বাধিয়া দিলাম । এমনি বারকতক যমুনা হইতে জল আনিয়া তাহার মুখে চক্ষে সিঞ্চন করার পর অল্পে অল্পে চেতনার সঞ্চার হইল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আর জল দিব ? কেশরলাল কহিলেন, ‘কে তুমি। আমি আর থাকিতে পারিলাম না, বলিলাম, অধীনা আপনার ভক্ত সেবিকা। আমি নবাব গোলামকাদের খণর কন্যা ।” মনে করিয়াছিলাম, কেশরলাল আসন্ন মৃত্যুকালে তাহার ভক্তের শেষ পরিচয় সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবেন, এ সুখ হইতে আমাকে কেহ বঞ্চিত করিতে পারিবে না । আমার পরিচয় পাইবামাত্র কেশরলাল সিংহের ন্যায় গর্জন করিয়া উঠিয়া বলিলেন, ‘বেইমানের কন্যা, বিধৰ্মী ! মৃত্যুকালে যবনের জল দিয়া তুই আমার ধর্ম নষ্ট করিলি!' এই বলিয়া প্রবল বলে আমার কপোলদেশে দক্ষিণ করতলের আঘাত করিলেন, আমি মূৰ্ছিতপ্রায় হইয়া চক্ষে অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম । তখন আমি ষোড়শী, প্রথম দিন অন্তঃপুর হইতে বাহিরে আসিয়াছি, তখনো বহিরাকাশের লুব্ধ তপ্ত স্বর্যকর আমার স্বকুমার কপোলের রক্তিম লাবণ্যবিভা অপহরণ করিয়া লয় নাই, সেই বহিঃসংসারে পদক্ষেপ করিবামাত্র সংসারের নিকট হইতে, আমার সংসারের দেবতার নিকট হইতে এই প্রথম সম্ভাষণ প্রাপ্ত হইলাম।” আমি নির্বাপিত-সিগারেটে এতক্ষণ মোহমুগ্ধ চিত্রাপিতের ন্যায় বসিয়া ছিলাম। গল্প শুনিতেছিলাম, কি ভাষা শুনিতেছিলাম, কি সংগীত শুনিতেছিলাম জানি না, আমার মুখে একটি কথা ছিল না । এতক্ষণ পরে আমি আর থাকিতে পারিলাম না, হঠাৎ বলিয়া উঠিলাম, "জানোয়ার।”