পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ Sవవి নবাবজাদী কহিলেন, “কে জানোয়ার ! জানোয়ার কি মৃত্যুযন্ত্রণার সময় মুখের নিকট সমাহৃত জলবিন্দু পরিত্যাগ করে।” আমি অপ্রতিভ হইয়া কহিলাম, “তা বটে। সে দেবতা।” নবাবজাদী কহিলেন, “কিসের দেবতা ! দেবতা কি ভক্তের একাগ্রচিত্তের সেবা প্রত্যাখ্যান করিতে পারে!” আমি বলিলাম, "তাও ঘটে । বলিয়া চুপ করিয়া গেলাম। নবাবপুত্ৰী কহিতে লাগিলেন, “প্রথমটা আমার বড়ো বিষম বাজিল। মনে হইল, সমস্ত বিশ্বজগৎ হঠাৎ আমার মাথার উপর চুরমার হইয়া ভাঙিয়া পড়িয়া গেল। মুহূর্তের মধ্যে সংজ্ঞা লাভ করিয়া সেই কঠোর কঠিন নিষ্ঠুর নির্বিকার পবিত্র বীর ব্রাহ্মণের পদতলে দূর হইতে প্রণাম করিলাম– মনে মনে কছিলাম, হে ব্রাহ্মণ, তুমি হীনের সেবা, পরের অন্ন, ধনীর দান, যুবতীর যৌবন, রমণীর প্রেম কিছুই গ্রহণ কর না ; তুমি স্বতন্ত্র, তুমি একাকী, তুমি নির্লিপ্ত, তুমি স্থদুর, তোমার নিকট আত্মসমর্পণ করিবার অধিকারও আমার নাই ! নবাবছহিতাকে ভূলুষ্ঠিতমস্তকে প্রণাম করিতে দেখিয়া কেশরলাল কী মনে করিল বলিতে পারি না, কিন্তু তাহার মুখে বিস্ময় অথবা কোনো ভাবাস্তর প্রকাশ পাইল না। শাস্তভাবে একবার আমার মুখের দিকে চাহিল ; তাহার পরে ধীরে ধীরে উঠিল। আমি সচকিত হইয়া আশ্রয় দিবার জন্ত আমার হস্ত প্রসারণ করিলাম, সে তাহা নীরবে প্রত্যাখ্যান করিল, এবং বহু কষ্টে যমুনার ঘাটে গিয়া অবতীর্ণ হইল। সেখানে একটি খেয়ানেীক বাধা ছিল। পার হইবার লোকও ছিল না, পার করিবার লোকও ছিল না । সেই নৌকার উপর উঠিয়া কেশরলাল বাধন খুলিয়া দিল, নৌকা দেখিতে দেখিতে মধ্যম্রোতে গিয়া ক্রমশ অদৃশু হইয়া গেল— আমার ইচ্ছা হইতে লাগিল, সমস্ত হৃদয়ভার, সমস্ত যৌবনভার, সমস্ত অনাদৃত ভক্তিভার লইয়া সেই অদৃপ্ত নৌকার অভিমুখে জোড়কর করিয়া সেই নিস্তব্ধ নিশীথে সেই চন্দ্রালোকপুলকিত নিস্তরঙ্গ যমুনার মধ্যে অকাল-বৃস্তচু্যত পুষ্পমঞ্জরীর ন্যায় এই ব্যর্থ জীবন বিসর্জন করি। কিন্তু পারিলাম না। আকাশের চন্দ্র, যমুনাপারের ঘনকৃষ্ণ বনরেখা, কালিন্দীর নিবিড় নীল নিষ্কম্প জলরাশি, দূরে আম্রবনের উর্ধ্বে আমাদের জ্যোৎস্নাচিকণ কেল্লার চুড়াগ্রভাগ, সকলেই নিঃশব্দগম্ভীর ঐকতানে মৃত্যুর গান গাহিল ; সেই নিশীথে গ্রহচন্দ্ৰতারাখচিত নিস্তব্ধ তিন ভুবন আমাকে একবাক্যে মরিতে কহিল। কেবল