পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২১৪ রবীন্দ্র-রচনাবলী এমন সময় একদিন মধ্যাহ্নে তাহার ঘরের মেজেতে একখানি চিঠির গুটিকতক ছিন্নাংশ কুড়াইয়া পাইলাম। জোড়া দিয়া দিয়া এই অসম্পূর্ণ বাক্যটুকু আদায় করিলাম, "আজ সন্ধ্যা সাতটার সময় গোপনে তোমার বাসায়”— অনেক খুজিয়া আর কিছু বাহির করিতে পারিলাম না। আমার অন্তঃকরণ পুলকিত হইয়া উঠিল ; মাটির মধ্য হইতে কোনো বিলুপ্তবংশ প্রাচীন প্রাণীর একখণ্ড হাড় পাইলে প্রত্নজীবতত্ত্ববিদের কল্পনা যেমন মহানন্দে সজাগ হইয়া উঠে আমারও সেই অবস্থা হইল । আমি জানিতাম, আজ রাত্রি দশটার সময় আমাদের বাসায় হরিমতির আবির্ভাব হইবার কথা আছে, ইতিমধ্যে সন্ধ্যা সাতটার সময় ব্যাপারখানা কী। ছেলেটির যেমন সাহল তেমনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। যদি কোনো গোপন অপরাধের কাজ করিতে হয় তবে ঘরে যেদিন কোনো একটা বিশেষ হাঙ্গামা সেই দিন অবকাশ বুঝিয়া করা ভালো। প্রথমত প্রধান ব্যাপারের দিকে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট থাকে, দ্বিতীয়ত যেদিন যেখানে কোনো বিশেষ সমাগম আছে সেদিন সেখানে কেহ ইচ্ছাপূর্বক কোনো গোপন ব্যাপারের অনুষ্ঠান করিবে ইহা কেহ সম্ভব মনে করে না । হঠাৎ আমার সন্দেহ হইল যে, আমার সহিত এই নূতন বন্ধুত্ব এবং হরিমতির সহিত এই প্রেমাভিনয়, ইহাকেও মন্মথ আপন কার্যসিদ্ধির উপায় করিয়া লইয়াছে ; এইজন্তই সে আপনাকে ধরাও দেয় না, আপনাকে ছাড়াইয়াও লয় না । আমরা তাহাকে তাহার গোপন কার্য হইতে আড়াল করিয়া রাখিয়াছি ; সকলেই মনে করিতেছে যে, সে আমাদিগকে লইয়াই ব্যাপৃত রহিয়াছে— সেও সে ভ্রম দূর করিতে চায় না । তর্কগুলা একবার ভাবিয়া দেখো । যে বিদেশী ছাত্র ছুটির সময় আত্মীয়স্বজনের অনুনয়বিনয় উপেক্ষা করিয়া শূন্ত বাসায় একলা পড়িয়া থাকে, নির্জন স্থানে তাহার বিশেষ প্রয়োজন আছে এ-বিষয়ে কণহারো সংশয় থাকিতে পারে না, অথচ আমি তাহার বাসায় আসিয়া তাহার নির্জনতা ভঙ্গ করিয়াছি ; এবং একটা রমণীর অবতারণা করিয়া নূতন উপদ্রব স্বজন করিয়াছি ; কিন্তু ইহা সত্ত্বেও সে বিরক্ত হয় না, বাসা ছাড়ে না, আমাদের সঙ্গ হইতে দূরে থাকে না— অথচ হরিমতি অথবা আমার প্রতি তাহার তিলমাত্র আসক্তি জন্মে নাই ইহা নিশ্চয় সত্য, এমন-কি তাহার অসতর্ক অবস্থায় বারম্বার লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছি, আমাদের উভয়ের প্রতি তাহার একটা আন্তরিক ঘৃণা ক্রমেই যেন প্রবল হইয়া উঠিতেছে। ইহার একমাত্র তাৎপর্ব এই যে, সজনতার সাফাইটুকু রক্ষা করিয়া নির্জনতার