পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૨૭ রবীন্দ্র-রচনাবলী “মাঝি, আজ আর আমার হুগলি যাওয়া হইল না, এইখান হইতেই বাড়ি ফেরো।" কিন্তু ফিরিবার সময় উজানে দাড় টানিতে হইল, সেই শব্দে আমি সংকুচিত হইয়া উঠিলাম। সেই দাড়ের শব্দে যেন এমন কাহাকে আঘাত করিতে লাগিল যাহা সচেতন স্বন্দর স্বকুমার, যাহা অনস্ত-আকাশ-ব্যাপী অথচ একটি হরিণশাবকের মতো ভীরু । নৌকা যখন ঘাটের নিকটবর্তী হইল তখন দাড়ের শব্দে আমার প্রতিবেশিনী প্রথমে ধীরে মুখ তুলিয়া যুদ্ধ কৌতুহলের সহিত আমার নৌকার দিকে চাহিল, মুহূর্ত পরেই আমার ব্যগ্রব্যাকুল দৃষ্ট দেখিয়া সে চকিত হইয়া গৃহমধ্যে চলিয়া গেল ; আমার মনে হইল, আমি যেন তাহাকে আঘাত করিলাম, যেন কোথায় তাহার বাজিল 1 । তাড়াতাড়ি উঠবার সময় তাহার ক্রোড় হইতে একটি অধৰ্দষ্ট স্বল্পপক পেয়ারা গড়াইতে গড়াইতে নিম্ন সোপানে আসিয়া পড়িল, সেই দশনচিহ্নিত অধরচুম্বিত ফলটির জন্য আমার সমস্ত অন্ত:করণ উৎসুক হইয়া উঠিল, কিন্তু মাঝিমাল্লাদের লজ্জায় তাহা দূর হইতে নিরীক্ষণ করিতে করিতে চলিয়া গেলাম। দেখিলাম, উত্তরোত্তর লোলুপায়মান জোয়ারের জল ছলছল লুব্ধ শব্দে তাহার লোল রসনার দ্বারা সেই ফলটিকে আয়ত্ত করিবার জন্য বারম্বার উন্মুখ হইয়া উঠিতেছে, আধ ঘণ্টার মধ্যে তাহার নির্লজ্জ অধ্যবসায় চরিতার্থ হইবে ইহাই কল্পনা করিয়া ক্লিষ্টচিত্তে আমি আমার বাড়ির ঘাটে আসিয়া উত্তীর্ণ হইলাম। বটবৃক্ষচ্ছায়ায় পা ছড়াইয়া দিয়া সমস্ত দিন স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম, ছুইখানি সুকোমল পদপল্লবের তলে বিশ্বপ্রকৃতি মাথা নত করিয়া পড়িয়া আছে— আকাশ আলোকিত, ধরণী পুলকিত, বাতাস উতলা, তাহারই মধ্যে দুইখানি অনাবৃত চরণ স্থির নিম্পন স্বন্দর ; তাহারা জানেও না যে, তাহাদেরই রেণুকণার মাদকতায় তপ্তযৌবন নববসন্ত দিগ্বিদিকে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে। ইতিপূর্বে প্রকৃতি আমার কাছে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন ছিল, নদী বন আকাশ সমস্তই স্বতন্ত্র ছিল। আজ সেই বিশাল বিপুল বিকীর্ণতার মাঝখানে একটি স্বন্দরী প্রতিমূর্তি দেখা দিবামাত্র তাহ অবয়ব ধারণ করিয়া এক হইয়া উঠিয়াছে। আজ প্রকৃতি আমার কাছে এক ও সুন্দর, সে আমাকে অহরহ মূকভাবে অকুনয় করিতেছে, “আমি মৌন, তুমি আমাকে ভাষা দেও, আমার অন্তঃকরণে যে-একটি অব্যক্ত স্তব উখিত হইতেছে তুমি তাহাকে ছন্দে লয়ে তানে তোমার স্বন্দর মানবভাষায় ধ্বনিত করিয়া তোলে৷ ” প্রকৃতির সেই নীরব অল্পনয়ে আমার হৃদয়ের সমস্ত তন্ত্রী বাজিতে থাকে। বারম্বার কেবল এই গান শুনি, “হে সুন্দরী, হে মনোহারিণী, হে বিশ্বজয়িনী, হে মনপ্রাণপতঙ্গের