পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৩০ রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রভৃতি কতকগুলি সেকাল-প্রচলিত ভ্রান্ত পুথি লইয়া এখনো নিযুক্ত রহিয়াছেন, ইহাতে র্তাহাকে আমি কৃপাপাত্র মনে করিতাম, এবং আমার নূতন বিষ্ঠা অত্যন্ত আড়ম্বরের সহিত জাহির করিতে ছাড়িতাম না। ভবনাথবাবু এমনি ভালোমানুষ, এমনি সকল বিষয়ে সসংকোচ ষে, আমার মতো অল্পবয়স্ক যুবকের মুখ হইতেও সকল কথা মানিয়া যাইতেন, তিলমাত্র প্রতিবাদ করিতে হইলে অস্থির হইয়া উঠিতেন, ভয় করিতেন পাছে আমি কিছুতে ক্ষুন্ন হই । কিরণ আমাদের এই-সকল তত্ত্বালোচনার মাঝখান হইতেই কোনো ছুতায় উঠিয়া চলিয়া যাইত। তাহাতে আমার যেমন ক্ষোভ জন্মিত তেমনি আমি গর্বও অনুভব করিতাম। আমাদের আলোচ্য বিষয়ের দুরূহ পাণ্ডিত্য কিরণের পক্ষে দুঃসহ ; সে যখন মনে মনে আমার বিদ্যাপর্বতের পরিমাপ করিত তখন তাহাকে কত উচ্চেই চাহিতে হইত। কিরণকে যখন দূর হইতে দেখিতাম তখন তাহাকে শকুন্তলা দময়ন্তী প্রভৃতি বিচিত্র নামে এবং বিচিত্র ভাবে জানিতাম, এখন ঘরের মধ্যে তাহাকে ‘কিরণ’ বলিয়া' জানিলাম, এখন আর সে জগতের বিচিত্র নায়িকার ছায়ারূপিণী নহে, এখন সে একমাত্র কিরণ । এখন সে শতশতাব্দীর কাব্যলোক হইতে অবতীর্ণ হইয়া, অনন্তকালের যুবকচিত্তের স্বপ্নস্বর্গ পরিহার করিয়া, একটি নির্দিষ্ট বাঙালিঘরের মধ্যে কুমারীকন্যারূপে বিরাজ করিতেছে । সে আমারই মাতৃভাষায় আমার সঙ্গে অত্যন্ত সাধারণ ঘরের কথা বলিয়া থাকে, সামান্ত কথায় সরলভাবে হাসিয়া উঠে, সে আমাদেরই ঘরের মেয়ের মতো দুই হাতে দুটি সোনার বালা পরিয়া থাকে, গলার হারটি বেশি কিছু নয় কিন্তু বড়ো স্বমিষ্ট, শাড়ির প্রাস্তটি কখনো কবরীর উপরিভাগ বাকিয় বেষ্টন করিয়া আসে কখনো বা পিতৃগৃহের অনভ্যাসবশত চ্যুত হইয়া পড়িয়া যায়, ইহা আমার কাছে বড়ো আনন্দের। সে যে অকাল্পনিক, সে যে সত্য, সে ষে কিরণ, সে যে তাহা ব্যতীত নহে এবং তাহার অধিক নহে, এবং যদিচ সে আমার নহে তবুও সে যে আমাদের, সেজন্ত আমার অন্ত:করণ সর্বদাই তাহার প্রতি উচ্ছসিত কৃতজ্ঞতারলে অভিষিক্ত হইতে থাকে। একদিন জ্ঞানমাত্রেরই আপেক্ষিকতা লইয়া ভবনাথবাবুর নিকট অত্যন্ত উৎসাহসহকারে বাচালতা প্রকাশ করিতেছিলাম ; আলোচনা কিয়দ্রর অগ্রসর হইবামাত্র কিরণ উঠিয়া গেল এবং অনতিকাল পরেই সম্মুখের বারান্দায় একটা তোলা উনান এবং রাধিবার সরঞ্জাম আনিয়া রাখিয়া, ভবনাথবাবুকে ভৎসনা করিয়া বলিল, “বাবা, কেন তুমি মহীন্দ্রবাবুকে ঐসকল শক্ত কথা লইয়া বৃথা বকাইতেছ! আস্থন মহীশ্রবাবু, তার চেয়ে আমার রান্নায় যোগ দিলে কাজে লাগিবে।”