পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ૨૮:૧ মানিক, যাহা বক্ষের, বাহা কণ্ঠের, বাহা মাখার— সেই অনেকদিনের অনেক সাধের সামগ্রী এক মুহূর্তেই ব্যবসায়ের অতলম্পর্শ গহ্বরের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইবে ইহা কল্পনা করিয়া তাহার সর্বশরীর হিম হইয়া আসিল । সে কছিল, ‘কী করা যায়।’ মধুসূদন কছিল, গহনাগুলো লইয়া এইবেলা বাপের বাড়ি চলে।’ গহনার কিছু অংশ, এমন-কি অধিকাংশই যে তাহার ভাগে আলিৰে বুদ্ধিমান মধু মনে মনে তাহার উপায় ঠাহরাইল । মণিমালিকা এ প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ সম্মত হইল । պա আষাঢ়শেষের সন্ধ্যাবেলায় এই ঘাটের ধারে একখানি নৌকা আসিয়া লাগিল । ঘনমেঘাচ্ছন্ন প্রত্যুষে নিবিড় অন্ধকারে নিদ্রাহীন ভেকের কলরবের মধ্যে একখানি মোট চাদরে পা হইতে মাথা পর্যন্ত আবৃত করিয়া মণিমালিকা নৌকায় উঠিল । মধুসূদন নৌকার মধ্য হইতে জাগিয়া উঠিয়া কহিল, গহনার বাক্সটা আমার কাছে দাও।” মণি কহিল, ‘সে পরে হইবে, এখন নৌকা খুলিয়া দাও।” নৌকা খুলিয়া দিল, খরস্রোতে হুহু করিয়া ভাসিয়া গেল । মণিমালিকা সমস্ত রাত ধরিয়া একটি একটি করিয়া তাহার সমস্ত গহনা সর্বাঙ্গ ভরিয়া পরিয়াছে, মাথা হইতে পা পর্যন্ত আর স্থান ছিল না। বাক্সে করিয়া গহনা লইলে লে বাক্স হাতছাড়া হইয়া যাইতে পারে, এ আশঙ্কা তাহার ছিল । কিন্তু, গায়ে পরিয়া গেলে তাহাকে না বধ করিয়া সে গহনা কেহ লইতে পরিবে না । সঙ্গে কোনোপ্রকার বাক্স না দেখিয়া মধুসুদন কিছু বুঝিতে পারিল না, মোট চাদরের নীচে যে মণিমালিকার দেহপ্রাণের সঙ্গে সঙ্গে দেহপ্রাণের অধিক গহনাগুলি আচ্ছন্ন ছিল তাহ সে অনুমান করিতে পারে নাই ! মণিমালিকা ফণিভূষণকে বুঝিত না বটে, কিন্তু মধুসূদনকে চিনিতে তাহার বাকি ছিল না। 顱 মধুসূদন গোমস্তার কাছে একখানা চিঠি রাখিয়া গেল যে, সে কত্রীকে পিত্রালয়ে পৌছাইয়া দিতে রওনা হইল। গোমস্তা ফণিভূষণের বাপের আমলের ; সে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া হ্রস্ব-ইকারকে দীর্ঘ-ঈকার এবং দস্ত্য-সকে তালব্য-শ করিয়া মনিবকে এক পত্র লিখিল, ভালো বাংলা লিখিল না কিন্তু স্ত্রীকে অযথা প্রশ্রয় দেওয়া যে পুরুষোচিত নহে এ কথাটা ঠিকমতই প্রকাশ করিল। ফণিভূষণ মণিমালিকার মনের কথাটা ঠিক বুঝিল । তাছার মনে এই আঘাতটা প্রবল হইল যে, “আমি গুরুতর ক্ষতিসম্ভাবনা সত্ত্বেও খ্রীয় অলংকার পরিত্যাগ করিয়া প্রাণপণ চেষ্টায় অর্থসংগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তবু আমাকে সন্দেহ । আমাকে জাজিও চিনিল না ।”