পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ لاوهچ ফুরিত হইতেছে। স্বপ্ন ভাঙিয়া দেখিল, বাহিরে জার-কোনো শব্দ নাই, কেবল শ্রাবণের ধারা তখনে ঝরঝর শৰে পড়িতেছিল এবং তাহারই সহিত মিশ্রিত হইয়া শুনা যাইতেছিল, যাত্রার ছেলেরা ভোরের স্বরে তাল ধরিয়াছে । যদিচ ব্যাপারটা সমস্তই স্বপ্ন কিন্তু এত অধিক নিকটবর্তী এবং সত্যবং যে ফণিভূষণের মনে হইল, যেন অতি অল্পের জন্যই সে তাহার অসম্ভব আকাঙ্ক্ষার আশ্চর্ষ সফলতা হইতে বঞ্চিত হইল। সেই জলপতনশদের সহিত দূরাগত ভৈরবীর তান তাহাকে বলিতে লাগিল, এই জাগরণই স্বপ্ন, এই জগৎই মিথ্যা । তাহার পরদিনেও যাত্রা ছিল এবং দরোয়ানেরও ছুটি ছিল । ফণিভূষণ হুকুম দিল, আজ সমস্ত রাত্ৰি যেন দেউড়ির দরজা খোলা থাকে । দরোয়ান কহিল, মেলা উপলক্ষে নানা দেশ হইতে নানাপ্রকার লোক আসিয়াছে, দরজা খোলা রাখিতে সাহল হয় না। ফণিভূষণ সে কথা মানিল না। দরোয়ান কহিল, তবে আমি সমস্ত রাত্রি হাজির থাকিয়া পাহারা দিব ।’ ফণিভূষণ কহিল, ‘সে হইবে না, তোমাকে যাত্রা শুনিতে যাইতেই হইবে।” দরোয়ান আশ্চর্ষ হইয়া গেল । পরদিন সন্ধ্যাবেলায় দীপ নিভাইয়া দিয়া ফণিভূষণ তাহার শয়নকক্ষের সেই বাতায়নে আসিয়া বসিল । আকাশে অবৃষ্টিসংরম্ভ মেঘ এবং চতুর্দিকে কোনো-একটি অনির্দিষ্ট আসন্নপ্রতীক্ষার নিস্তব্ধতা । ভেকের অপ্রাস্ত কলরব এবং যাত্রার গানের চিংকারধ্বনি সেই স্তব্ধতা ভাঙিতে পারে নাই, কেবল তাহার মধ্যে একটা অসংগত অদ্ভুতরল বিস্তার করিতেছিল। অনেকরাত্রে একসময়ে ভেক এবং ঝিল্লি এবং যাত্রার দলের ছেলেরা চুপ করিয়া গেল এবং রাত্রের অন্ধকারের উপরে আরো একটা কিলের অন্ধকার আসিয়া পড়িল । বুঝা গেল, এইবার সময় আসিয়াছে। পূর্বদিনের মতো নদীর ঘাটে একটা ঠকঠক এবং ঝম্‌ঝম্ শৰ উঠিল। কিন্তু, ফণিভূষণ সে দিকে চোখ ফিরাইল না । তাহার ভয় হইল, পাছে অধীর ইচ্ছা এবং অশাস্ত চেষ্টায় তাহার সকল ইচ্ছা সকল চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া যায়। পাছে আগ্রহের বেগ তাহার ইঞ্জিয়শক্তিকে অভিভূত করিয়া ফেলে। সে আপনার সকল চেষ্টা নিজের মনকে দমন করিবার জন্য প্রয়োগ করিল, কাঠের মূর্তির মতো শক্ত হইয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। শিঞ্জিত শৰ আজ ঘাট হইতে ক্ৰমে ক্রমে অগ্রসর হইয়া মুক্ত দ্বারের মধ্যে প্রবেশ করিল। শুনা গেল, অনার মহলের গোলসিড়ি দিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে শৰ উপরে উঠতেছে। ফণিভূষণ আপনাকে আর দমন করিতে পারে না, তাহার বক্ষ তুফানের