পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૭ર রবীন্দ্র-রচনাবলী ডিঙির মতো আছাড় খাইতে লাগিল এবং নিশ্বাস রোধ হইবার উপক্রম হইল । গোলসিড়ি শেষ করিয়া সেই শব্দ বারান্দা দিয়া ক্রমে ঘরের নিকটবর্তী হইতে লাগিল । অবশেষে ঠিক সেই শয়নকক্ষের দ্বারের কাছে আসিয়া খট্‌খটু এবং ঝম্‌ঝম্ থামিয়া গেল । কেবল চৌকাঠটি পার হইলেই হয়। ফণিভূষণ আর থাকিতে পারিল না। তাহার রুদ্ধ আবেগ এক মুহূর্তে প্রবলবেগে উচ্ছ্বলিত হইয়া উঠিল ; সে বিদ্যুদবেগে চৌকি হইতে উঠিয়া কাদিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘মণি ! আমনি সচকিত হইয়া জাগিয়া দেখিল, তাহারই সেই ব্যাকুল কণ্ঠের চিৎকারে ঘরের শাসিগুলা পর্যস্ত ধ্বনিত স্পন্দিত হইতেছে। বাহিরে সেই ভেকের কলরব এবং যাত্রার ছেলেদের ক্লিষ্ট কণ্ঠের গান। ফণিভূষণ নিজের ললাটে সবলে আঘাত করিল। পরদিন মেলা ভাঙিয়া গেছে । দোকানি এবং যাত্রার দল চলিয়া গেল । ফণিভূষণ হুকুম দিল, সেইদিন সন্ধ্যার পর তাহার বাড়িতে সে নিজে ছাড়া আর কেহই থাকিবে না। চাকরেরা স্থির করিল, বাৰু তান্ত্রিকমতে একটা কী সাধনে নিযুক্ত আছেন । ফণিভূষণ সমস্তদিন উপবাস করিয়া রহিল। জনশূন্ত বাড়িতে সন্ধ্যাবেলায় ফণিভূষণ বাতায়নতলে আসিয়া বলিল। সেদিন আকাশের স্থানে স্থানে মেঘ ছিল না, এবং ধৌত নির্মল বাতাসের মধ্য দিয়া নক্ষত্রগুলিকে অত্যুজ্জল দেখাইতেছিল। কৃষ্ণপক্ষ দশমীর চাদ উঠিতে অনেক বিলম্ব আছে । মেলা উত্তীর্ণ হইয়া যাওয়াতে পরিপূর্ণ নদীতে নৌকা মাত্রই ছিল না এবং উৎসবজাগরণক্লাস্ত গ্রাম দুইরাত্রি জাগরণের পর আজ গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন । ফণিভূষণ একখানা চৌকিতে বলিয়া চৌকির পিঠের উপর মাথা উর্ধ্বমুখ করিয়া তারা দেখিতেছিল ; ভাবিতেছিল, একদিন যখন তাহার বয়স ছিল উনিশ, যখন কলিকাতার কালেজে পড়িত, যখন সন্ধ্যাকালে গোলদিঘির তৃণশয়নে চিত হইয়া, হাতের উপরে মাথা রাখিয়া, ঐ অনস্তকালের তারাগুলির দিকে চাহিয়া থাকিত এবং মনে পড়িত তাহার সেই নদীকূলবর্তী শ্বশুরবাড়ির একটি বিরলকক্ষে চোদ্ধবৎসরের বয়ঃসন্ধিগত মণির সেই উজ্জল কাচা মুখখানি, তখনকার সেই বিরহ কী স্বমধুর, তখনকার সেই তারাগুলির আলোকম্পন্দন হৃদয়ের যৌবনম্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে কী বিচিত্র বসন্তরাগেণ যতিতালাভ্যাং’ বাজিয়া বাজিয়া উঠিত । আজ সেই একই তারা আগুন দিয়া আকাশে মোহমুদগরের শ্লোক কয়টা লিখিয়া রাখিয়াছে ; বলিতেছে, সংসারোহয়মতীব বিচিত্ৰ: ! দেখিতে দেখিতে তারাগুলি সমস্ত লুপ্ত হইয়া গেল। আকাশ হইতে একখানা