পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ૨૭૭ অন্ধকার নামিয়া এবং পৃথিবী হইতে একখানা অন্ধকার উঠিয়া চোখের উপরকার এবং নীচেকার পল্লবের মতো একত্র আসিয়া মিলিত হইল। আজ ফণিভূষণের চিত্ত শাস্ত ছিল । সে নিশ্চয় জানিত, আজ তাহার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে, সাধকের নিকট মৃত্যু আপন রহস্য উদঘাটন করিয়া দিবে। পূর্বরাত্রির মতো সেই শব্দ নদীর জলের মধ্য হইতে ঘাটের সোপানের উপর উঠিল। ফণিভূষণ দুই চক্ষু নিমৗলিত করিয়া স্থির দৃঢ়চিত্তে ধ্যানাসনে বসিল । শৰ দ্বারীণুষ্ঠ দেউড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল, শৰ জনশূন্ত অন্তঃপুরের গোলসিড়ির মধ্য দিয়া ঘূরিয়া ঘূরিয়া উঠিতে লাগিল, শব্দ দীর্ঘ বারান্দ পার হইল এবং শয়নকক্ষের ভারের কাছে আসিয়া ক্ষণকালের জন্ত থামিল । ফণিভূষণের হৃদয় ব্যাকুল এবং সর্বাঙ্গ কণ্টকিত হইয়া উঠিল, কিন্তু আজ সে চক্ষু খুলিল না। শব্দ চৌকাঠ পার হইয়া অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। আলনায় যেখানে শাড়ি কেঁচানো আছে; কুলুঙ্গিতে যেখানে কেরোলিনের দীপ দাড়াইয়া, টিপাইয়ের ধারে যেখানে পানের বাটায় পান শুদ্ধ, এবং সেই বিচিত্রসামগ্রীপূর্ণ আলমারির কাছে প্রত্যেক জায়গায় এক-একবার করিয়া দাড়াইয়া অবশেষে শৰাট ফণিভূষণের অত্যন্ত কাছে আসিয়া থামিল । তখন ফণিভূষণ চোখ মেলিল এবং দেখিল, ঘরে নবোদিত দশমীর চন্দ্রালোক আসিয়া প্রবেশ করিয়াছে, এবং তাহার চৌকির ঠিক সম্মুখে একটি কঙ্কাল দাড়াইয়া । সেই কঙ্কালের আট আঙুলে আংটি, করতলে রতনচক্র, প্রকোষ্ঠে বাল, বাহতে বাজুবন্ধ, গলায় কষ্টি, মাথায় লিখি, তাহার আপাদমস্তকে অস্থিতে অস্থিতে এক-একটি আভরণ সোনায় হীরার ঝকঝক্ করিতেছে। অলংকারগুলি ঢিল, ঢলঢ়ল করিতেছে, কিন্তু অল্প হইতে খসিয়া পড়িতেছে না। সর্বাপেক্ষ ভয়ংকর, তাহার অস্থিময় মুখে তাহার দুই চক্ষু ছিল সজীব , সেই কালো তারা, সেই ঘনদীর্ঘ পক্ষ, সেই সজল উজ্জ্বলতা, সেই অবিচলিত দৃঢ়শাস্তি দৃষ্টি। আজ আঠারো বৎসর পূর্বে একদিন আলোকিত সভাগৃহে নহবতের সাহান আলাপের মধ্যে ফণিভূষণ যে দুটি আয়তস্বন্দর কালে-কালো ঢলঢল চোখ শুভদৃষ্টিতে প্রথম দেখিয়াছিল সেই দুটি চক্ষুই জাজ শ্রাবণের অধরাত্রে কৃষ্ণপক্ষ দশমীর চন্দ্রকিরণে দেখিল ; দেখিয় তাহার সর্বশরীরে রক্ত হিম হইয়া আসিল । প্রাণপণে দুই চক্ষু বুজিতে চেষ্টা করিল, কিছুতেই পারিল না , তাহার চক্ষু মৃত মানুষের চক্ষুর মতো নির্নিমেষ চাহিয়৷ রছিল। তখন সেই কাল অভিত ফণিভূষণের মুখের দিকে তাহার দৃষ্টি স্থির রাখিয়া