পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ &ፃ› তখন ইত্যাদি। বার বার সেই এক কথা । দেবী তখন কেবল নিরুত্তরে ভ্ৰকুটি করিলেন এবং একটা ভয়ংকর আশঙ্কার অন্ধকারে আমার সমস্ত অন্তঃকরণ আচ্ছন্ন হইয়া গেল । আমার অমৃতপ্ত স্বামী চাকরদাসীকে নিযেধ করিয়া নিজে আমার সকল কাজ করিয়া দিতে উষ্ঠত হইলেন। স্বামীর উপর তুচ্ছ বিষয়েও এইরূপ নিরুপায় নির্ভর প্রথমটা ভালোই লাগিত। কারণ, এমনি করিয়া সর্বদাই তাহাকে কাছে পাইতাম । চোখে তাহাকে দেখিতাম না বলিয়া তাহাকে সর্বদা কাছে পাইবার আকাঙ্ক্ষা অত্যস্ত বাড়িয়া উঠিল । স্বামীস্কখের যে অংশ আমার চোখের ভাগে পড়িয়াছিল সেইটে এখন অন্য ইঞ্জিয়েরা বাটিয়া লইয়া নিজেদের ভাগ বাড়াইয়া লইবার চেষ্টা করিল। এখন আমার স্বামী অধিকক্ষণ বাহিরের কাজে থাকিলে মনে হইত, আমি যেন শূন্তে রছিয়াছি, আমি যেন কোথাও কিছু ধরিতে পারিতেছি না, আমার যেন সব হারাইল । পূর্বে স্বামী যখন কলেজে যাইতেন তখন বিলম্ব হইলে পথের দিকের জানালা একটুখানি ফাক করিয়া পথ চাহিয়া থাকিতাম। যে জগতে তিনি বেড়াইতেন সে জগৎটাকে আমি চোখের দ্বারা নিজের সঙ্গে বাধিয়া রাখিয়াছিলাম । আজ আমার দৃষ্টিহীন সমস্ত শরীর তাহাকে অন্বেষণ করিতে চেষ্টা করে। তাহার পৃথিবীর সহিত আমার পৃথিবীর যে প্রধান সাকো ছিল সেটা আজ ভাঙিয়া গেছে। এখন তাহার এবং আমার মাঝখানে একটা দুস্তর অন্ধতা ; এখন আমাকে কেবল নিরুপায় ব্যগ্রভাবে বসিয়া থাকিতে হয়, কখন তিনি তাহার পার হইতে আমার পারে আপনি আসিয়া উপস্থিত হইবেন । সেইজন্ত এখন, যখন ক্ষণকালের জন্তও তিনি আমাকে ছাড়িয়া চলিয়া যান তখন আমার সমস্ত অন্ধ দেহ উদ্যত হইয়া তাহাকে ধরিতে যায়, হাহাকার করিয়া তাহাকে ডাকে । কিন্তু এত আকাঙ্ক্ষা, এত নির্ভর তো ভালো নয় । একে তো স্বামীর উপরে স্ত্রীর ভারই যথেষ্ট, তাহার উপরে আবার অন্ধতার প্রকাও ভার চাপাইতে পারি না । আমার এই বিশ্বজোড়া অন্ধকার, এ আমিই বহন করিব। আমি একাগ্রমনে প্রতিজ্ঞা করিলাম, আমার এই অনন্ত অন্ধতা দ্বারা স্বামীকে আমি আমার সঙ্গে বাধিয়া রাখিব না । অল্পকালের মধ্যেই কেবল শঙ্ক-গন্ধ-স্পর্শের দ্বারা আমি আমার সমস্ত অভ্যস্ত কর্ম সম্পন্ন করিতে শিখিলাম। এমন-কি আমার অনেক গৃহকর্ম পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি নৈপুণ্যের সহিত নির্বাহ করিতে পারিলাম। এখন মনে হইতে লাগিল, দৃষ্টি আমাদের কাজের যতটা সাহায্য করে তাহার চেয়ে ঢের বেশি বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয় ।