পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩১২ রবীন্দ্র-রচনাবলী অর্থাৎ, হাটের মধ্যে ছোটোয় বড়োয় যেমন গায়ে গায়ে ভিড় করে তেমনি, সভার মধ্যে যেমন তারা যথাযোগ্য আসন পায় তেমন নয় । ছন্দ:কুসুম বইটির লেখক প্রাকৃত-বাংলার ছন্দ সম্বন্ধে অনুষ্ঠুভ ছন্দে বিলাপ করে বলছেন— পাচগলী নাম বিখ্যাতা সাধারণ-মনোরমা । পয়ার ত্রিপদী আদি প্রাকৃতে হয় চালনা ৷ দ্বিপাদে শ্লোক সংপূর্ণ তুল্যসংখ্যার অক্ষরে। পাঠে দুই পদে মাত্র শেষাক্ষর সদা মিলে । পঠনে সে সব ছন্দ: রাখিতে তালগৌরব । পঠিছে সর্বদা লোকে উচ্চারণ-বিপর্যয়ে ॥ লঘুকে গুরু সম্ভাষে দীর্ঘবর্ণে কহে লঘু। হ্রস্বে দীৰ্ঘে সমজ্ঞানে উচ্চারণ করে সবে । কবির এই বিলাপের সঙ্গে আমিও যোগ দিচ্ছি। কেবল আমি এই বলতে চাই, প্রাকৃত বাংলার ছন্দে এমনতরো দুর্ঘটনা ঘটে না, এ-সব ঘটে সংস্কৃত-বাংলার ছন্দে । প্রাকৃতবাংলার যে স্বকীয় দীর্ঘত্বস্বতা আছে তার ছন্দে তার বিপর্যয় দেখি নে, কিন্তু সাধু ভাষায় দেখি । এই প্রাকৃত-বাংলা মেয়েদের ছড়ায়, বাউলের গানে, রামপ্রসাদের পদে আপন স্বভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু সাধুসভায় তার সমাদর হয় নি বলে সে মুখ ফুটে নিজের সব কথা বলতে পারে নি এবং তার শক্তি যে কত তারও সম্পূর্ণ পরিচয় হল না। আজকের দিনের ডিমক্রেসির যুগেও সে ভয়ে ভয়ে দ্বিধা করে চলেছে ; কোথায় যে তার পঙক্তি এবং কোথায় নয় তা স্থির হয় নি । এই সংকোচে তার আত্মপরিচয়ের খর্বতা হচ্ছে । আমরা একটা কথা ভুলে যাই প্রাকৃত-বাংলার লক্ষ্মীর পেট্রায় সংস্কৃত, পারসি, ইংরেজি প্রভৃতি নানা ভাষা থেকেই শব্দসঞ্চয় হচ্ছে, সেইজন্তে শব্দের দৈন্য প্রাকৃত-বাংলার স্বভাবগত বলে মনে করা উচিত নয়। প্রয়োজন হলেই আমরা প্রাকৃত-ভাণ্ডারে সংস্কৃত শব্দের আমদানি করতে পারব। কাজেই যেখানে অর্থের বা ধ্বনির প্রয়োজনবশত সংস্কৃত শব্দই সংগত সেখানে প্রাকৃত-বাংলায় তার বাধা নেই । আবার ফার্সি কথাও তার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা একসারে বসিয়ে দিতে পারি। সাধুবাংলায় তার বিঘ্ন আছে, কেননা সেখানে জাতিরক্ষণ করাকেই সাধুত রক্ষা করা বলে। প্রাকৃত ভাষার এই ঔদার্থ গন্তে পদ্যে আমাদের সাহিত্যের একটি পরম সম্পদ, এই কথা মনে রাখতে হবে। চৈত্র ১৩২৪