পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৬২ রবীন্দ্র-রচনাবলী ছন্দ সম্বন্ধে আরো কিছু বলা বাকি রইল, আর কোনো সময়ে পরে বলবার ইচ্ছা আছে। উপসংহারে আজ কেবল এই কথাটি বলতে চাই যে, ছন্দের একটা দিক আছে যেটাকে বলা যেতে পারে কৌশল। কিন্তু, তার চেয়ে আছে বড়ো জিনিস যেটাকে বলি সৌষ্ঠব। বাহাদুরি তার মধ্যে নেই, সমগ্র কাব্যস্থষ্টির কাছে ছন্দের আত্মবিস্মৃত আত্মনিবেদনে তার উদ্ভব। কাব্য পড়তে গিয়ে যদি অনুভব করি যে, ছন্দ পড়ছি, তা হলে সেই প্ৰগলভ ছন্দকে ধিক্কার দেব। মস্তিষ্ক হৃৎপিণ্ড পাকস্থলী অতি আশ্চর্য যন্ত্র, স্বষ্টিকর্তা তাদের স্বাতন্ত্র্য ঢাকা দিয়েছেন । দেহ তাদেরকে ব্যবহার করে, প্রকাশ করে না । করে প্রকাশ যখন রোগে ধরে ; তখন যক্লংটা হয় প্রবল, তার কাছে মাথা হেঁট করে লাবণ্য । শরীরে স্বাস্থ্যের মতোই কবি ছন্দকে ভুলে থাকে, ছন্দ যখন তার যথার্থ আপন হয় । বৈশাখ ১৩৪১ গদ্যছন্দ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত কথা যখন খাড়া দাড়িয়ে থাকে তখন সে কেবলমাত্র আপন অর্থটুকু নিবেদন করে। যখন তাকে ছন্দের আঘাতে নাড়া দেওয়া যায় তখন তার কাছ থেকে অর্থের বেশি আরো কিছু বেরিয়ে পড়ে । সেটা জানার জিনিস নয়, বেদনার জিনিস। সেটাতে পদার্থের পরিচয় নয়, রসের সম্ভোগ । আবেগকে প্রকাশ করতে গেলে কথার মধ্যে আবেগের ধর্ম সঞ্চার করতে হয় । আবেগের ধর্ম হচ্ছে বেগ ; সে চলে, চালায় । কথা যখন সেই বেগ গ্রহণ করে তখন স্পন্দিত হৃদয়ভাবের সঙ্গে তার সাধর্ম্য ঘটে । চলতি ভাষায় আমরা বলি কথাকে ছন্দে বাধা । বাধা বটে, কিন্তু সে বাধন বাইরে, রূপের দিকে ভাবের দিকে মুক্তি । যেমন সেতারে তার বাধা, তার থেকে স্বর পায় ছাড়া। ছন্দ সেই সেতারের বাধা তার, স্বরের বেগে কথাকে অস্তরে দেয় মুক্তি । উপনিষদে আছে, আত্মার লক্ষ্য ব্রহ্ম, ওঙ্কারের ধ্বনিবেগ তাকে ধন্থর মতো লক্ষ্যে পৌছিয়ে দেয়। এতে বলা হচ্ছে, বাক্যের দ্বারা যুক্তির দ্বারা ব্ৰহ্ম জানবার বিষয় নন, তিনি আত্মার সঙ্গে একাত্ম হবার বিষয় । এই উপলব্ধিতে ধ্বনিই সহায়তা করে, শব্দার্থ করে না । জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় উভয়ের মধ্যে মোকাবিলা হয় মাত্র ; অর্থাৎ সান্নিধ্য হয়, সাযুজ্য