পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8२४” রবীন্দ্র-রচনাবলী দেহে মনের উজ্জলতা ঝলমল করে বেড়ায়। সকল বিষয়েই তার ঔংস্থক্য। সায়ান্সে যেমন তার মন সাহিত্যে তার চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। ময়দানে ফুটবল দেখতে যেতে তার অসীম আগ্রহ, সিনেমা দেখাটাকে সে অবজ্ঞা করে না । প্রেসিডেন্সি কলেজে বিদেশ থেকে এসেছে ফিজিক্সের ব্যাখ্যাকর্তা, সে সভাতেও সে উপস্থিত। রেডিয়োতে কান পাতে, হয়তো বলে ছ্যাঃ’, কিন্তু কৌতুহলও যথেষ্ট। বিয়ে করতে রাস্তা দিয়ে বর চলেছে বাজনা বাজিয়ে, ও ছুটে আসে বারানায়। জুওলজিকালে বারে বারে বেড়িয়ে আসে, ভারি আমোদ লাগে, বিশেষত বাদরের খাচার সামনে দাড়িয়ে । বাবা যখন মাছ ধরতে যেতেন ছিপ নিয়ে ও তার পাশে গিয়ে বসত। টেনিস খেলে, ব্যাডমিণ্টন খেলায় ওস্তাদ । এ-সব দাদার কাছে শিক্ষা । তন্ত্রী সে সঞ্চারিণী লতার মতো, একটু হাওয়াতেই দুলে ওঠে। সাজসজ্জা সহজ এবং পরিপাটি। জানে কেমন করে শাড়িটাতে এখানে ওখানে অল্প একটুখানি টেনেটুনে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, চিল দিয়ে, জাট ক’রে অঙ্গশোভা রচনা করতে হয়, অথচ তার রহস্যভেদ করা যায় না । গান ভালো গাইতে জানে না, কিন্তু সেতার বাজায় । সেই সংগীত দেখবার না শোনবার কে জানে । মনে হয় ওর দুরন্ত আঙুলগুলি কোলাহল করছে। কথা কবার বিষয়ের অভাব ঘটে না কখনো, হাসবার জন্তে সংগত কারণের অপেক্ষা করতে হয় না। সঙ্গদান করবার অজস্র ক্ষমতা, যেখানে থাকে সেখানকার ফাক ও একলা ভরিয়ে রাখে । কেবল নীরদের কাছে ও হয়ে যায় আর-এক মানুষ, পালের নৌকোর হাওয়া যায় বন্ধ হয়ে, গুণের টানে চলে নম্রমন্থর গমনে । সবাই বলে, উর্মির স্বভাব ওর ভাইয়েরই মতো প্রাণপরিপূর্ণ। উমি জানে, ওর ভাই ওর মনকে মুক্তি দিয়েছে। হেমস্ত বলত, আমাদের ঘরগুলো এক-একটা ছাচ, মাটির মানুষ গড়বার জন্যেই। তাই তো এতকাল ধরে বিদেশী বাজিকর এত সহজে তেত্রিশ কোটি পুতুলকে নাচিয়ে বেড়িয়েছে। সে বলত, ‘আমার যখন সময় আসবে তখন এই সামাজিক পৌত্তলিকতা ভাঙবার জন্যে কালাপাহাড়ি করতে বেরোব ।’ সময় হল না, কিন্তু উমির মনকে খুবই সজীব করে রেখে দিয়ে গেছে। মুশকিল বাধল এই নিয়ে। নীরদের কার্যপ্রণালী অত্যন্ত বিধিবদ্ধ। উর্মির জন্যে পাঠ্যপর্যায়ের বাধা নিয়ম করে দিলে। ওকে উপদেশ দিয়ে বললে, “দেখো উর্মি, মনটাকে পথে চলতে চলতে কেবলই চলকিয়ে ফেলো না, পথের শেষে যখন পৌছোবে তখন দ্বড়াটাতে বাকি থাকবে কী ।”