পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ss» রবীন্দ্র-রচনাবলী সম্বন্ধে বেচারা জানে না যে সে ইংরেজি জানে না। ভারী ভারী শক জুটিয়ে এনে, পুথিগত দীর্ঘপ্রস্থ বচন ষোজনা করে, ওর বাক্যগুলোকে করে তুলত বস্তা-বোঝাই গোরুর গাড়ির মতো । উর্মির হাসি আসত, কিন্তু হাসতে সে লজ্জা পেত ; নিজেকে তিরষ্কার করে বলত, বাঙালির ইংরেজিতে ক্ৰটি হলে তা নিয়ে দোষ ধরা হ্মবিশ। দেশে থাকতে মোকাবিলায় যখন নীরদ ক্ষণে ক্ষণে সমুপদেশ দিয়েছে তখন ওর রকম-সকমে সেগুলো গভীর হয়ে উঠেছে গৌরবে। যতটা কানে শোনা যেত তার চেয়ে আন্দাজে তার ওজন হত বেশি। কিন্তু লম্বা চিঠিতে আন্দাজের জায়গা থাকে না । কোমর-বাধা ভারী ভারী কথা হালকা হয়ে যায়, মোট মোট আওয়াজেই ধরা পড়ে বলবার বিষয়ের কমতি । নীরদের যে ভাবটা কাছে থাকতে ও সয়ে গিয়েছিল সেইটে দূরের থেকে ওকে সব চেয়ে বাজে। লোকটা একেবারেই হাসতে জানে না। চিঠিতে সব চেয়ে প্রকাশ পায় সেই অভাবটা । এই নিয়ে শশাঙ্কের সঙ্গে তুলনা ওর মনে আপনিই এসে পড়ে। তুলনার একটা উপলক্ষ এই সেদিন হঠাৎ ঘটেছে। কাপড় খুজতে গিয়ে বাক্সের তলা থেকে বেরোল পশমে-বোন। একপাটি অসমাপ্ত জুতো । মনে পড়ে গেল চার বছর আগেকার কথা । তখন হেমন্ত ছিল বেঁচে। ওরা সকলে মিলে গিয়েছিল দাৰ্জিলিঙে। আমোদের অস্ত ছিল না। হেমন্তে আর শশাঙ্কে মিলে ঠাট্রাতামাশার পাগলা ঝোরা বইয়ে দিয়েছিল। উমি তার এক মাসির কাছ থেকে পশমের কাজ নতুন শিখেছে। জন্মদিনে দাদাকে দেবে বলে একজোড়া জুতো বুনছিল। তা নিয়ে শশাঙ্ক ওকে কেবলই ঠাট্টা করত ; বলত, "দাদাকে আর যাই দাও, জুতো নয়। ভগবান মন্থ বলেছেন ওতে গুরুজনের অসম্মান হয় ।” উমি কটাক্ষ করে বলেছিল, “ভগবান মন্ত্র তবে কাকে প্রয়োগ করতে বলেন।” শশাঙ্ক গম্ভীর মুখে বললে, “অসম্মানের সনাতন অধিকার ভগ্নীপতির। আমার পাওনা আছে। সেটা স্বদে ভারী হয়ে উঠল।”

  • মনে তো পড়ছে না ।” “পড়বার কথা নয়, তখন ছিলে নিতান্ত নাবালিকা। সেই কারণেই তোমার দিদির সঙ্গে শুভলগ্নে যেদিন এই সৌভাগ্যবানের বিবাহ হয়, সেদিন বাসররজনীর কর্ণধারপদ গ্রহণ করতে পার নি। আজ সেই কোমল করপল্লবের অরচিত কান-মলাটাই রূপ গ্রহণ করছে সেই করপল্লবরচিত জুতোযুগলে । ওটার প্রতি আমার দাবি রইল জানিয়ে রেখে দিলুম।" |

দাবি শোধ হয় নি, সে জুতো যথাসময়ে প্রণামীরূপে নিবেদিত হয়েছিল দাদার চরণে।