পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সেই হাস্তোজ্জল আকাশে হালকা পাখায় উড়ে-যাওয়া দিনগুলি ! এখন থেকে সামনে প্রসারিত নিরবকাশ কর্তব্যকঠোর মরুজীবন । আজ ২৬শে ফাঙ্কন । হোলিখেলার দিন । মফঃস্বলের কাজে এ খেলায় শশাঙ্কের সময় ছিল না, এ দিনের কথা তারা ভুলেই গেছে। উমি আজ তার শয্যাগত দিদির পায়ে আবীরের টিপ দিয়ে প্রণাম করেছে। তার পরে খুজতে খুজতে গিয়ে দেখলে, শশাঙ্ক আপিস-দ্বরের ডেস্কে ঝুকে পড়ে একমনে কাজ করছে। পিছন থেকে গিয়ে দিলে তার মাথায় আবীর মাখিয়ে, রাঙিয়ে উঠল তার কাগজপত্র। মাতামাতির পালা পড়ে গেল। ডেস্কে ছিল দোয়াতে লাল কালি। শশাঙ্ক দিলে উমির শাড়িতে ঢেলে । হাত চেপে ধরে তার আঁচল থেকে ফাগ কেড়ে নিয়ে উর্মির মুখে দিলে ঘযে, তার পরে দৌড়াদৌড়ি, ঠেলাঠেলি, চেঁচামেচি। বেলা যায় চলে, স্নানাহারের সময় যায় পিছিয়ে, উমির উচ্চহাসির স্বরোচ্ছ্বাসে সমস্ত বাড়ি মুখরিত। শেষকালে শশাঙ্কের অস্বাস্থ্যআশঙ্কায় দূতের পরে দূত পাঠিয়ে শৰ্মিলা এদের নিবৃত্ত করলে। দিন গেছে। রাত্রি হয়েছে অনেক । পুষ্পিত কৃষ্ণচূড়ার শাখাজাল ছাড়িয়ে পূর্ণচাদ উঠেছে অনাবৃত আকাশে। হঠাৎ ফাস্তুনের দমকা হাওয়ায় ঝরঝর শব্দে দোলাদুলি করে উঠেছে বাগানের সমস্ত গাছপালা, তলাকার ছায়ার জাল তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। জানলার কাছে উমি চুপ করে বসে। ঘুম আসছে না কিছুতেই। বুকের মধ্যে রক্তের দোলা শাস্ত হয় নি। আমের বোলের গন্ধে মন উঠেছে ভরে । আজ বসন্তে মাধবীলতার মজ্জায় মজ্জায় যে ফুল ফোটাবার বেদনা সেই বেদন যেন উর্মির সমস্ত দেহকে ভিতর থেকে উংস্থক করেছে। পাশের নাবার ঘরে গিয়ে মাথা ধুয়ে নিলে, গা মুছলে ভিজে তোয়ালে দিয়ে। বিছানায় শুয়ে এ পাশ ও-পাশ করতে করতে কিছুক্ষণ পরে স্বপ্নজড়িত ঘুমে আবিষ্ট হয়ে পড়ল । রাত্রি তিনটের সময় ঘুম ভেঙে চাদ তখন জানলার সামনে নেই। ঘরে অন্ধকার, বাইরে আলোয় ছায়ায় জড়িত স্বপারিগাছের বীথিক । উর্মির বুক ফেটে কান্না এল, কিছুতে থামতে চায় না। উপুড় হয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুজে কাদতে লাগল। প্রাণের এই কান্না— ভাষায় এর শব্দ নেই, অর্থ নেই। প্রশ্ন করলে ও কি বলতে পারে, কোথা থেকে এই বেদনার জোয়ার উদবেলিত হয়ে ওঠে ওর দেহে মনে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় দিনের কর্মতালিকা, রাত্রের স্থখনিদ্রা ? সকালে উমি যখন ঘুম ভেঙে উঠল তখন ঘরের মধ্যে রৌদ্র এসে পড়েছে। সকালবেলাকার কাজে ফাক পড়ল, ক্লাস্তির কথা মনে করে শর্মিলা ওকে ক্ষমা করেছে। কিসের অনুতাপে উমি আজ অবসন্ন। কেন মনে হচ্ছে, ওর হার হতে চলল। দিদিকে