পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ছারখার করে দিলে। পুরাতনের মধ্যে নূতন মিশিয়ে, বিশ্বাসের মধ্যে সংশয় এনে, সন্তোষের মধ্যে রাশার আক্ষেপ উৎক্ষিপ্ত করে দিয়ে সমস্ত বিপর্যন্ত করে দিলে। মনে করে আমাদের চতুর্দিকে হিমান্ত্রি এবং সমূত্রের বাধা যদি আরো দুর্গম হত তা হলে এক-দল মানুষ একটি অজ্ঞাত নিভৃত বেষ্টনের মধ্যে স্থির-শাস্ত-ভাবে একপ্রকার সংকীর্ণ পরিপূর্ণতা লাভের অবসর পেত। পৃথিবীর সংবাদ তার বড়ো একটা জানতে পেত না এবং ভূগোলবিবরণ সম্বন্ধে তাদের নিতান্ত অসম্পূর্ণ ধারণা থাকত ; কেবল তাদের কাব্য, তাদের সমাজতন্ত্র, তাদের ধর্মশাস্ত্র, তাদের দর্শনতত্ত্ব অপূর্ব শোভা স্বযমা এবং সম্পূর্ণতা লাভ করতে পেত ; তারা যেন পৃথিবী-ছাড়া আর-একটি ছোটো গ্রহের মধ্যে বাস করত ; তাদের ইতিহাস, তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান স্থখ-সম্পদ তাদের মধ্যেই পর্যাপ্ত থাকত। সমুদ্রের এক অংশ কালক্রমে মৃত্তিকাস্তরে রুদ্ধ হয়ে যেমন একটি নিতৃত শাস্তিময় স্বন্দর হ্রদের স্বষ্টি হয় ; সে কেবল নিস্তরঙ্গভাবে প্রভাতসঙ্ক্যার বিচিত্র বর্ণচ্ছায়ায় প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে এবং অন্ধকার রাত্রে স্তিমিত নক্ষত্রালোকে স্তম্ভিতভাবে চিররহস্তের ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে থাকে। কালের বেগবান প্রবাহে, পরিবর্তন-কোলাহলের কেন্দ্রস্থলে, প্রকৃতির সহস্ৰ শক্তির রণরঙ্গভূমির মাঝখানে সংক্ষুব্ধ হয়ে খুব একটা শক্ত-রকম শিক্ষা এবং সভ্যতা লাভ হয় সত্য বটে ; কিন্তু নির্জনতা নিস্তব্ধতা গভীরতার মধ্যে অবতরণ করে যে কোনো রত্ব সঞ্চয় করা যায় না তা কেমন করে বলব । এই মথ্যমান সংসারসমূত্রের মধ্যে সেই নিস্তব্ধতার অবসর কোনো জাতিই পায় নি। মনে হয় কেবল ভারতবর্ষই এক কালে দৈবক্রমে সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে সেই বিচ্ছিন্নতা লাভ করেছিল এবং অতলম্পর্শের মধ্যে অবগাহন করেছিল। জগৎ যেমন অসীম মানবের আত্মাও তেমনি অসীম ; যারা সেই অনাবিষ্কৃত অস্তর্দেশের পথ অনুসন্ধান করেছিলেন তারা যে কোনো নূতন সত্য এবং কোনো নূতন আনন্দ লাভ করেন নি ত৷ নিতান্ত অবিশ্বাসীর কথা । ভারতবর্ষ তখন একটি রুদ্ধদ্বার নির্জন রহস্যময় পরীক্ষাকক্ষের মতো ছিল ; তার মধ্যে এক অপরূপ মানসিক সভ্যতার গোপন পরীক্ষা চলছিল। য়ুরোপের মধ্যযুগে যেমন আলকেমি-তত্ত্বাম্বেষীরা গোপন গৃহে নিহিত থেকে বিবিধ অদ্ভূত যন্ত্রতন্ত্ৰযোগে চিরজীবনরস (Elixir of Life) আবিষ্কার করবার চেষ্টা করেছিলেন, আমাদের জ্ঞানীরাও সেইরূপ গোপন সতর্কতা-সহকারে আধ্যাত্মিক চিরজীবন -লাভের উপায় অন্বেষণ করেছিলেন। তার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘যেনাহং নামৃতাস্তাম কিমহং তেন কুর্ষাম এবং অত্যন্ত দুঃসাধ্য উপায়ে অন্তরের মধ্যে সেই অস্বতরসের সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।