পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8bre রবীন্দ্র-রচনাবলী করেছি তা বহু সাধনার ধন, তা অতিযত্নে রক্ষা করবার যোগ্য ; সেইজন্যই আমরা ম্লেচ্ছ যবনদের সংস্পর্শ সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করতে চেষ্টা করে থাকি। এ সম্বন্ধে দুটি কথা বলবার অাছে। প্রথমত আমরা সকলেই যে বিশেষরূপে পবিত্রতার চর্চা করে থাকি তা নয়, অথচ অধিকাংশ মানবজাতিকে অপবিত্র জ্ঞান করে একটা সম্পূর্ণ অস্তায় বিচার, অমূলক অহংকার, পরস্পরের মধ্যে অনর্থক ব্যবধানের স্বাক্ট করা হয়। এই পবিত্রতার দোহাই দিয়ে এই বিজাতীয় মানবস্তৃণা আমাদের চরিত্রের মধ্যে যে কীটের স্তায় কার্য করে তা অনেকে অস্বীকার করে থাকেন। তারা অম্লানমুখে বলেন, কই, আমরা ঘৃণা কই করি! আমাদের শাস্ত্রেই যে আছে বস্থধৈব কুটুম্বকম। শাস্ত্রে কী আছে এবং বুদ্ধিমানের ব্যাখ্যায় কী দাড়ায় তা বিচার্য নয়, কিন্তু আচরণে কী প্রকাশ পায় এবং সে আচরণের আদিম কারণ যাই থাকৃ তার থেকে সাধারণের চিত্তে স্বভাবতই মানবস্থণার উৎপত্তি হয় কি না, এবং কোনো-একটি জাতির আপামর সাধারণে অপর সমস্ত জাতিকে নিবিচারে ঘৃণা করবার অধিকারী কি না, তাই বিবেচনা করে দেখতে হবে । আর-একটি কথা, জড়পদার্থ ই বাহ মলিনতায় কলঙ্কিত হয় । শখের পোশাকটি পরে যখন বেড়াই তখন অতি সন্তপণে চলতে হয়। পাছে ধুলো লাগে, জল লাগে, কোনো-রকম দাগ লাগে, অনেক সাবধানে আসন গ্রহণ করতে হয়। পবিত্রতা যদি পোশাক হয় তবেই ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় পাছে এর ছোওয়া লাগলে কালো হয়ে যায়, ওর হাওয়া লাগলে চিহ্ন পড়ে। এমন একটি পোশাকি পবিত্রতা নিয়ে সংসারে বাস করা কী বিষম বিপদ। জনসমাজের রণক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে এবং রঙ্গভূমিতে ঐ অতি পরিপাট পবিত্রতাকে সামলে চলা অত্যন্ত কঠিন হয় বলে শুচিবায়ুগ্ৰস্ত দুর্ভাগ জীব আপন বিচরণ-ক্ষেত্র অত্যন্ত সংকীর্ণ করে আনে, আপনাকে কাপড়টা-চোপড়টার মতো সর্বদ সিন্দুকের মধ্যে তুলে রাখে, মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ কখনোই তার দ্বারা সম্ভব হয় না। আত্মার আন্তরিক পবিত্রতার প্রভাবে বাহ মলিনতাকে কিয়ৎপরিমাণে উপেক্ষ না করলে চলে না। অত্যন্ত রূপপ্রয়াসী ব্যক্তি বর্ণবিকারের ভয়ে পৃথিবীর ধুলামাটি জলরৌদ্র বাতাসকে সর্বদা ভয় করে চলে এবং ননির পুতুলটি হয়ে নিরাপদ স্থানে বিরাজ করে। ভুলে যায় যে, বর্ণসৌকুমার্ষ সৌন্দর্ষের একটি বাহ উপাদান, কিন্তু স্বাস্থ্য তার একটি প্রধান আভ্যস্তরিক প্রতিষ্ঠাভূমি— জড়ের পক্ষে এই স্বাস্থ্য অনাবশ্যক, সুতরাং তাকে ঢেকে রাখলে ক্ষতি নেই। কিন্তু আত্মাকে যদি মৃত জ্ঞান না কর তবে কিয়ৎপরিমাণে মলিনতার আশঙ্কা থাকলেও তার স্বাস্থ্যের উদ্দেশে, তার বল উপার্জনের উদ্দেশে, তাকে সাধারণ জগতের সংস্রবে আনা আবশ্যক ।