পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SVV রবীন্দ্র-রচনাবলী নরেশ । মহারানী সুমিত্ৰা তো ফাকি নন । তিনি তো পর্বত থেকে নেমে এসেছেন আমাদের জয়লক্ষ্মীর অনুবর্তিনী হয়ে । বিপাশা। চুপ করো, চুপ করো। দুঃখের কথা মনে করিয়ে দিয়ে না। রাজকন্যা তখন বালিকা, বয়েস যোলো। খুড়োমহারাজ এসে বললেন, বিজয়ীর কাছে আত্মসমপণ করতে হবে, নইলে সন্ধি অসম্ভব । রাজকুমায়ী আগুন জ্বালিয়ে ঝাপ দিয়ে মরতে গিয়েছিলেন । পুরবৃন্ধরা এসে বললে, মা,রক্ষা করো, যে পাণি মৃত্যুবর্ষণ করছে তোমার পাণি দিয়ে তাকে অধিকার করে- শান্তি হােক । নরেশ । কিন্তু সেদিনকার কোনো গ্লানি তো মহারানীর মনে নেই। প্ৰসন্ন মহিমায় সিংহাসনে তার আপন স্থান নিয়েছেন । বিপাশা। মহাদুঃখ ভোলবার মতোই মহাশক্তি র্তার, তিনি যে সতীলক্ষ্মী । মৃত্যুর জন্যে যে আগুন জ্বলেছিল তাকে সাক্ষী করে তার বিবাহ । তিনদিন কৈলাসনাথের মন্দিরে ধ্যানে বসে উপবাস করে নিজেকে শুদ্ধ করে নিয়েছেন । অসহ্য অপমানকে নিঃশেষে নিজের মধ্যে দগ্ধ করে নিয়ে তবে এলেন তোমাদের ঘরে । বীরাঙ্গনার ক্ষমা যদি না থাকত। তবে আগুন ধরত তোমাদের সিংহাসনে । নরেশ । জান বিপাশা, ঐ বীরাঙ্গনা আপন মহিমাচ্ছটায় কাশ্মীরের দিকে আমাদের হৃদয়ের একটি দীপ্যমান ছায়াপথ ঐকে দিয়েছেন । জালন্ধরের যুবকদের মন তিনি উদাস করেছেন ঐ কাশ্মীরের মুখে । তিনি তাদের ধ্যানের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছেন একটি অপরূপ জ্যোতিমূর্তি । তুমি জান না, জালন্ধর থেকে কত পাগল গেছে ঐ কাশ্মীরে, খুঁজতে তাদের সাধনার ধনকে । বিপাশা । হায় রে, এ তো যুদ্ধ করা নয় । ওখানে তোমাদের অস্ত্ৰ চলাবার রাস্তা থাকতেও পারে কিন্তু হৃদয়জয়ের পথ ও দিকে বন্ধ করে দিয়েছ তোমাদের বর্বরতা দিয়ে । নরেশ । সাধনা করতে হবে- তাতেও তো আনন্দ আছে । বিপাশা । তা করো, কিন্তু সিদ্ধির আশা ছেড়ে দাও । নরেশ । সিদ্ধি হবেই, আমি একলাই তা প্ৰমাণ করব- কাশ্মীর পর্যন্ত না গিয়ে ! বিপাশা । তোমার যত বড়ো অহংকার তত বড়োই দুরাশা ৷ নরেশ । দুরাশাই আমার, সেই আমার অহংকার। আমার আকাঙক্ষা পর্বতের দুৰ্গম শিখর। সেখানে প্ৰভাতের দুর্লভ তারাকে দেখি, ভোরের স্বপ্নে । বিপাশা। তোমাদের কবির কাছে পাঠ মুখস্থ করে এলে বুঝি ? নরেশ । প্রয়োজন হয় না । বাইরে যার কাছ থেকে পাই কঠোর কথা, অন্তরে সেই দেয় বাণীর বর, গোপনে । যদি সাহস দাও তার নামটি তোমাকে বলি । বিপাশা । কাজ নেই অত সাহসে । নরেশ । তবে থাক । কিন্তু এই পদ্মের কুঁড়ি, একে নিতে দোষ কী । এও তো মুখ ফুটে কিছু বলে না | বিপাশা । না, নেব না । নরেশ । কাশ্মীরের সরোবর থেকে এর মূল এনেছিলুম। অনেকদিন অনেক দ্বিধার পরে দেখা দিয়েছে তার এই কুঁড়িটি। মনে হচ্ছে আমার সৌভাগ্য তার প্রথম নিদর্শনপত্রটি পাঠিয়েছে- এর মধ্যে একজনের অদৃশ্য স্বাক্ষর আছে। নেবে না ? এই রেখে গেলাম তোমার পায়ের কাছে। [ প্ৰস্থানোদ্যম বিপাশা । শোনো, শোনো, আবার বলছি তোমরা কাশ্মীর জয় কর নি । নরেশ । নিশ্চয় করেছি । সেজন্যে রাগ করতে পার, অবজ্ঞা করতে পারবে না । জয় করেছি । বিপাশা । ছল করে । নরেশ । না, যুদ্ধ করে । বিপাশা । তাকে যুদ্ধ বলে না। নরেশ । হা, যুদ্ধই বলে ।