পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ver রবীন্দ্র-রচনাবলী বিপাশা। রাজার আজ্ঞা নাকি । সুমিত্ৰা । যার আজ্ঞা তার বেদী সাজাবি চল। ঐ পদ্মের কুঁড়িটিই তোর প্রথম অর্ঘ্য হােক । বিপাশা। যেয়ে না তুমি, তবে একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, সত্য করে বলে । মকরকেতনের পূজায় আজ রাত্রে যে উৎসব হবে তাতে তোমার উৎসাহ আছে ? সুমিত্ৰা । মহারাজের আদেশ । বিপাশা। সে তো জানি কিন্তু তোমার নিজের মন কী বলে - চুপ করে থাকবে ? সুমিত্ৰা । হা, চুপ করেই থাকব। বিপাশা । আচ্ছা বেশ । কিন্তু একটা প্রশ্ন এতদিন তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে সাহস করি নি- আজ জিজ্ঞাসা করবই- চুপ করে থাকলে চলবে না । সুমিত্ৰা । কী প্রয় তোর। বিপাশা। সত্যই কি তুমি মহারাজকে ভালোবাস । বলতেই হবে আমাকে । সুমিত্ৰা । ই ভালোবাসি । উত্তর শুনে চুপ করে রাইলি যে ! বিপাশা। তবে সত্য কথা বলি তোমাকে । আর কিছুদিন আগে এ প্রশ্নও আমার মনে আসত না, উত্তর শুনলেও মেনে নিতুম । সুমিত্ৰা । আজ নিজের মনের সঙ্গে মনে মনে মিলিয়ে দেখছিস বুঝি । বিপাশা। তা তোমাকে লুকোব না, সবই তুমি জানো- মিলিয়ে দেখছি বৈকি, কিন্তু ঠিক মেলাতে পারছি নে । সুমিত্ৰা । কী করে মিলবে। প্রজােরক্ষার করুণায় কাশ্মীরের অসম্মান স্বীকার ক’রে যেদিন আমি মহারাজের কাছে আত্মসমৰ্পণ করতে সম্মত হয়েছিলুম তখন তিন দিন ধরে কৈলাসনাথের মন্দিরে কিসের জন্যে তপস্যা করেছি ? বিপাশা। আমি হলে জালন্ধরের বিনিপাতের জন্যে তপস্যা করতুম | সুমিত্ৰা । এই শক্তি চেয়েছিলুম, রুদ্রের প্রসাদে আমার বিবাহ যেন ভোগের না হয় । জলন্ধরের রাজগৃহে আমি কোনোদিন কিছুর জন্যেই যেন লোভ না করি ; তবেই আমাকে অপমান স্পর্শ করতে পারবে না । বিপাশা । কোনোদিন তোমার মন বিচলিত হয় নি, মহারানী ? সুমিত্ৰা । প্রতিদিন হয়েছে- হাজারবার হয়েছে । বিপাশা। মাপ করো মহারানী, আমার সন্দেহ হয় তুমি তাকে অবজ্ঞা কর । সুমিত্ৰা । অবজ্ঞা ! এমন কথা বলিস নে, বিপাশা।। ওঁর মধ্যে তুচ্ছ কিছুই নেই। প্রচণ্ড ওঁর শক্তি- সে শক্তিতে বিলাসের আবিলতা নেই, আছে উল্লাসের উদ্দামতা। আমি যদি সেই কুল-ভাঙা বন্যার ধারে এসে দাড়াতুম, তা হলে আমার সমন্ত কোথায় ভেসে যেত, ধর্মকর্ম, শিক্ষাদীক্ষা । ঐ শক্তির দুর্জয়তাকে অহরহ ঠেকাতে গিয়েই আমার মন এমন পাষাণ হয়ে উঠল । এত অজস্র দান কোনো নারী পায় না- এই দুর্লভ সৌভাগ্যকে প্রত্যাখ্যান করবার জন্যে নিজের সঙ্গে আমার এমন দুর্বিষহ দ্বন্দ্ব । মহারাজকে যদি অবজ্ঞা করতে পারতুম তা হলে তো সমস্তই সহজ হত । অন্তরে বাহিরে আমার দুঃখ যে কত দুঃসহ তা তিনিই জানেন যার কাছে ব্ৰত নিয়েছিলুম। বিপাশা। ব্ৰত যেন রাখলে, মহারানী, কিন্তু ভালোবাসা ! সুমিত্রা। কী বলিস, বিপাশা। এই ব্ৰতই তো আমার ভালোবাসাকে বঁচিয়ে রেখেছে, নইলে ধিককারের মধ্যে তলিয়ে যেত সে । প্রেম যদি লজার বিষয় হয় তবে তার চেয়ে তার বিনাশ কী হতে পারে । আমার প্রেমকে বাচিয়েছেন তপস্বী মৃত্যুঞ্জয় । বিবাহের হােমাগ্নি থেকে আমার এ প্ৰেম গ্ৰহণ করেছি- আহুতির আর অন্ত নেই। বিপাশা। নিষ্ঠুর তোমার দেবতা, আমি কিন্তু তাকে মানতে পারতুম না। সুমিত্রা। কী করে জানালি। তিনি ডাক দিলেই তোকেও মানতে হত। কিন্তু বিপাশা, ব্ৰতের কথা