পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ტრეკ\ე রবীন্দ্র-রচনাবলী মধ্যে ব্ৰাহ্মণভোজন করাইয়া দক্ষিণা দিত। আমি নিজে হইতে তাহাকে অর্থসাহায্য করিয়া বলিতাম, ‘তুই কেশরলালকে নিমন্ত্ৰণ করিবি না ? সে জিভ কাটিয়া বলিত, 'কেশরলালঠাকুর কাহারও অন্নগ্ৰহণ বা দানপ্ৰতিগ্রহ করেন না ।” এইরূপে প্ৰত্যক্ষে বা পরোক্ষে কেশরলালকে কোনোরূপ ভক্তিচিহ্ন দেখাইতে না পারিয়া আমার চিত্ত যেন ক্ষুব্ধ ক্ষুধাতুর হইয়া থাকিত । আমাদের পূর্বপুরুষের কেহ-একজন একটি ব্ৰাহ্মণকন্যাকে বলপূর্বক বিবাহ করিয়া আনিয়াছিলেন, আমি অন্তঃপুরের প্রান্তে বসিয়া তাহারই পুণ্যরক্তপ্রবাহ। আপনি শিরার মধ্যে অনুভব করিতাম, এবং সেই রক্তসূত্রে কেশরলালের সহিত একটি ঐক্যসম্বন্ধ কল্পনা করিয়া কিয়ৎপরিমাণে তৃপ্তি বোধ হইত। রামায়ণ-মহাভারতের সমস্ত অপূর্ব ইতিহাস তন্ন তন্ন করিয়া শুনিতাম, শুনিয়া সেই অবরুদ্ধ অন্তঃপুরের প্রান্তে বসিয়া হিন্দুজগতের এক অপরূপ দৃশ্য আমার মনের সম্মুখে উদঘাটিত হইত। মূর্তিপ্রতিমূর্তি, শঙ্খ ঘণ্টাধ্বনি, স্বর্ণচূড়াখচিত দেবালয়, ধূপধুনার ধূম, অগুরুচন্দনমিশ্রিত পুষ্পরাশির সুগন্ধ, যোগীসন্ন্যাসীর অলৌকিক ক্ষমতা, ব্ৰাহ্মণের অমানুষিক মাহাত্ম্য, মানুষ-ছিদ্মবেশধারী দেবতাদের বিচিত্র লীলা, সমস্ত জড়িত হইয়া আমার নিকটে এক অতিপুরাতন অতিবিতীর্ণ অতি সুন্দর অপ্রাকৃত মায়ালোক সুজন করিত ; আমার চিত্ত যেন নীড়হারা ক্ষুদ্র পক্ষীর ন্যায় প্রদোষকালের একটি প্ৰকাণ্ড প্রাচীন প্রাসাদের কক্ষে কক্ষে উড়িয়া উড়িয়া বেড়াইত । হিন্দুসংসার আমার বালিকাহািদয়ের নিকট একটি পরামরমণীয় রূপকথার রাজ্য ছিল । এমন সময় কোম্পানি বাহাদুরের সহিত সিপাহিলোকের লড়াই বাধিল । আমাদের বদ্রাওনের ক্ষুদ্র কেল্লাটির মধ্যেও বিপ্লবের তরঙ্গ জাগিয়া উঠিল । কেশরলাল বলিল, “এইবার গো-খাদক গোরালোককে আর্যবর্ত হইতে দূর করিয়া দিয়া আর-একবার হিন্দুস্থানে হিন্দুমুসলমানে রাজপদ লইয়া দ্যূতক্রীড়া বসাইতে হইবে।” আমার পিতা গোলামকাদের খ্যা সাবধানী লোক ছিলেন ; তিনি ইংরেজ জাতিকে কোনো একটি বিশেষ কুটুম্বসম্ভাষণে অভিহিত করিয়া বলিলেন, “উহারা অসাধ্য সাধন করিতে পারে, হিন্দুস্থানের লোেক উহাদের সহিত পারিয়া উঠিবে না। আমি অনিশ্চিত প্রত্যাশে আমার এই ক্ষুদ্র কেল্লাটুকু খোয়াইতে পারিব না, আমি কোম্পানিবাহাদুরের সহিত লড়িব না।” যখন হিন্দুস্থানের সমস্ত হিন্দুমুসলমানের রক্ত উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে, তখন আমার পিতার এই বণিকের মতো সাবধানতায় আমাদের সকলের মনেই ধিককার উপস্থিত হইল। আমার বেগম মাতৃগণ পর্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠি আপনি যদি আমাদের পক্ষে যোগ না দেন। তবে যতদিন লড়াই চলে আপনাকে বন্দী রাখিয়া আপনার কেল্লার আধিপত্যভার আমি গ্ৰহণ করিব।” পিতা বলিলেন, “সে-সমস্ত হাঙ্গামা কিছুই করিতে হইবে না, তোমাদের পক্ষে আমি রহিব ।” কেশরলাল কহিলেন, “ধনকোষ হইতে কিছু অর্থ বাহির করিতে হইবে।” পিতা বিশেষ কিছু দিলেন না ; কহিলেন, “যখন যেমন আবশ্যক হইবে আমি দিব ।” আমার সীমান্ত হইতে পদাঙ্গুলি পর্যন্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যতকিছু ভূষণ ছিল সমস্ত কাপড়ে বাধিয়া আমার হিন্দু দাসী দিয়া গোপনে কেশরলালের নিকট পঠাইয়া দিলাম। তিনি গ্ৰহণ করিলেন । আনন্দে আমার ভূষণবিহীন প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুলকে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল । কেশরলাল মরিচাপড়া বন্দুকের চোঙ এবং পুরাতন তলোয়ারগুলি মজিয়া ঘষিয়া সাফ করিতে প্ৰস্তুত হইলেন, এমন সময় হঠাৎ একদিন অপরাঢ়ে জিলার কমিশনার সাহেব লালকুর্তি গোরা লইয়া আকাশে ধুলা উড়াইয়া আমাদের কেল্লার মধ্যে আসিয়া প্ৰবেশ করিল। আমার পিতা গোলামকাদের খা গোপনে তাহাকে বিদ্রোহসংবাদ দিয়াছিলেন ।