পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VSO রবীন্দ্র-রচনাবলী মুদ্রিত হয় নাই। আমি সেই যে দেখিয়ছিলাম, নিঃশব্দে জ্যোৎস্নানিশীথে নিন্তব্ধ যমুনার মধ্যম্রোতে একখানি ক্ষুদ্র নীেকার মধ্যে একাকী কেশরলাল ভাসিয়া চলিয়াছে, সেই চিত্ৰই আমার মনে অঙ্কিত হইয়া আছে। আমি কেবল অহরহ দেখিতেছিলাম, ব্ৰাহ্মণ নির্জন স্রোত বাহিয়া নিশিদিন কোন অনির্দেশ মহারহস্যাভিমুখে ধাবিত হইতেছে, তাহার কোনো সঙ্গী নাই, সেবক নাই, কাহাকেও তাহার কোনো আবশ্যক নাই, সেই নির্মল আত্মনিমগ্ন পুরুষ আপনাতে আপনি সম্পূৰ্ণ ; আকাশের গ্রহচন্দ্ৰতারা তাহাকে নিঃশব্দে নিরীক্ষণ করিতেছে । এমন সময় সংবাদ পাইলাম, কেশরলাল রাজদণ্ড হইতে পলায়ন করিয়া নেপালে আশ্রয় লইয়াছে । আমি নেপালে গেলাম । সেখানে দীর্ঘকাল বাস করিয়া সংবাদ পাইলাম, কেশরলাল বহুকাল হইল নেপাল ত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে কেহ জানে না । তাহার পর হইতে পাহাড়ে পাহাড়ে ভ্ৰমণ করিতেছি । এ হিন্দুর দেশ নহে— ভুটিয়া লেপচাগণ স্লেচ্ছ, ইহাদের আহারব্যবহারে আচার বিচার নাই, ইহাদের দেবতা ইহাদের পূজাৰ্চনাবিধি সকলই স্বতন্ত্র । বহুদিনের সাধনায় আমি যে বিশুদ্ধ শুচিতা লাভ করিয়াছি, ভয় হইতে লাগিল, পাছে তাহাতে রেখামাত্র চিহ্ন পড়ে । আমি বহু চেষ্টায় আপনাকে সর্বপ্রকার মলিন সংস্পর্শ হইতে রক্ষা করিয়া চলিতে লাগিলাম । আমি জানিতাম, আমার তরী তীরে আসিয়া পৌঁছিয়াছে, আমার জীবনের চরমতীৰ্থ অনতিদূরে । তাহার পরে আর কী বলিব । শেষ কথা অতি স্বল্প ৷ প্ৰদীপ যখন নেবে তখন একটি ফুৎকারেই নিবিয়া যায়, সে কথা আর সুদীর্ঘ করিয়া কী ব্যাখ্যা করিব । আটত্রিশ বৎসর পরে এই দাৰ্জিলিঙে আসিয়া আজ প্ৰাতঃকালে কেশরলালের দেখা পাইয়াছি।” বক্তাকে এইখানে ক্ষান্ত হইতে দেখিয়া আমি ঔৎসুক্যের সহিত জিজ্ঞাসা করিলাম, “কী দেখিলেন ।” নবাবপুত্রী কহিলেন, “দেখিলাম, বৃদ্ধ কেশরলাল ভুটিয়াপল্লীতে ভুটিয়া স্ত্রী এবং তাহার গর্ভজাত পৌত্রপৌত্রী লইয়া স্নানবস্ত্রে মলিন অঙ্গনে ভুট্টা হইতে শস্য সংগ্ৰহ করিতেছে।” গল্প শেষ হইল । আমি ভাবিলাম, একটা সাত্মনার কথা বলা আবশ্যক । কহিলাম, “আটত্রিশ বৎসর একাদিক্ৰমে যাহাকে প্রাণভয়ে বিজাতীয়ের সংস্রবে। অহরহ থাকিতে হইয়াছে সে কেমন করিয়া আপন আচার রক্ষা করিবে ।” নবাব কন্যা কহিলেন, “আমি কি তাহা বুঝি না । কিন্তু এতদিন আমি কী মোহ লইয়া ফিরিতেছিলাম ! যে ব্ৰহ্মণ্য আমার কিশোর হৃদয় হরণ করিয়া লইয়াছিল। আমি কি জানিতাম, তাহা অভ্যাস তাহা সংস্কার মাত্র । আমি জানিতাম, তাহা ধর্ম, তাহা অনাদি অনন্ত । তাহাই যদি না হইবে তবে যোলোবৎসর বয়সে প্রথম পিতৃগৃহ হইতে বাহির হইয়া সেই জ্যোৎস্নানিশীথে আমার বিকশিত পুষ্পিত ভক্তিবেগকম্পিত দেহমনপ্রাণের প্রতিদানে ব্রাহ্মণের দক্ষিণ হস্ত হইতে যে দুঃসহ অপমান প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, কেন তাহা গুরুহস্তের দীক্ষার ন্যায় নিঃশব্দে অবনত মস্তকে দ্বিগুণিত ভক্তিভরে শিরোধার্য করিয়া লইয়াছিলাম । হায় ব্ৰাহ্মণ, তুমি তো তোমার এক অভ্যাসের পরিবর্তে আর-এক অভ্যাস লাভ করিয়াছ, আমি আমার এক যৌবন এক জীবনের পরিবর্তে আর-এক জীবন যৌবন কোথায় ফিরিয়া পাইব ?” এই বলিয়া রমণী উঠিয়া দাড়াইয়া কহিল, “নমস্কার বাবুজি ।” মুহূর্তপরেই যেন সংশোধন করিয়া কহিল, “সেলাম বাবুসাহেব !” এই মুসলমান-অভিবাদনের দ্বারা সে যেন জীর্ণভিত্তি ধূলিশায়ী ভগ্ন ব্ৰহ্মাণ্যের নিকট শেষ বিদায় গ্ৰহণ করিল। আমি কোনো কথা না বলিতেই সে সেই হিমাদ্রিশিখরের ধূসর কুত্ত্বটিকারাশির মধ্যে মেঘের মতো মিলাইয়া গেল । আমি ক্ষণকাল চক্ষু মুদ্রিত করিয়া সমস্ত ঘটনাবলী মানসপট চিত্রিত দেখিতে লাগিলাম । মছলন্দের আসনে যমুনাতীরের গবাক্ষে সুখাসীনা ষোড়শী নবাববালিকাকে দেখিলাম, তীর্থমন্দিরে