পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SSS রবীন্দ্র-রচনাবলী কুসুম যেদিন তাঁস খেলিবার সাথি না পাইত সেদিন তাহার তরুণ দেবর নগেন্দ্ৰকে ধরিয়া আনিত । নগেন্দ্র ও বিনোদার আপত্তি হাসিয়া উড়াইয়া দিত। এ সংসারে এক হইতে আর হয় এবং খেলা ক্রমে সংকটে পরিণত হইতে পারে, এ-সব গুরুতর কথা অল্পবয়সে হঠাৎ বিশ্বাস হয় না । এ সম্বন্ধে নগেন্দ্রেরও আপত্তির দৃঢ়তা কিছুমাত্র দেখা গেল না, এখন আর সে তাস খেলিবার জন্য অধিক পীড়াপীডির অপেক্ষা করিতে পারে না । এইরূপে বিনোদার সহিত নগেন্দ্রের প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ হইতে লাগিল । নগেন্দ্র যখন তাস খেলিতে বসিত তখন তাসের অপেক্ষা সজীবতর পদার্থের প্রতি তাহার নয়নমন পডিয়া থাকতে খেলায় প্রায়ই হারিতে লাগিল। পরাজয়ের প্রকৃত কারণ বুঝিতে কুসুম এবং বিনোদার কাহারও বাকি রহিল না। পূর্বেই বলিয়াছি, কর্মফলের শুরুত্ব বোঝা অল্প বয়সের কর্ম নহে। কুসুম মনে করিত, এ একটা বেশ মজা হইতেছে, এবং মজাটা ক্রমে ষোলো-আনায় সম্পূৰ্ণ হইয়া উঠে৷ ইহাতে তাহার একটা আগ্রহ ছিল । ভালোবাসার নবাকুরে গোপনে জলসিঞ্চন তরুণীদের পক্ষে বড়ো কৌতুকের । বিনোদারও মন্দ লাগিল না । হৃদয়জয়ের সুতীক্ষ ক্ষমতাটা একজন পুরুষ মানুষের উপর শাণিত করিবার ইচ্ছা অন্যায় হইতে পারে, কিন্তু নিতান্ত অস্বাভাবিক নহে । এইরূপে তাসের হারজিৎ ও ছক্কাপাঞ্জার পুনঃপুন আবর্তনের মধ্যে কোন-এক সময়ে দুইটি খেলোয়াড়ের মনে মনে মিল হইয়া গেল, অন্তর্যামী ব্যতীত আর-একজন খেলোয়াড় তাহা দেখিল এবং আমোদ বোধ করিল। - একদিন দুপুরবেলায় বিনোদা কুসুম ও নগেন্দ্র তাস খেলিতেছিল। কিছুক্ষণ পরে কুসুম তাহার রুগণ শিশুর কান্না শুনিয়া উঠিয়া গেল। নগেন্দ্র বিনোদার সহিত গল্প করিতে লাগিল। কিন্তু কী গল্প করিতেছিল তাহা নিজেই বুঝিতে পারিতেছিল না ; রক্তস্রোত তাহার হৃৎপিণ্ড উদবেলিত করিয়া তাহার সর্বশরীরের শিরার মধ্যে তরঙ্গিত হইতেছিল । হঠাৎ একসময় তাহার উদ্দাম যৌবন বিনয়ের সমস্ত বাধ ভাঙিয়া ফেলিল, হঠাৎ বিনোদার হাত দুটি চাপিয়া ধরিয়া সবলে তাহাকে টানিয়া লইয়া চুম্বন করিল। বিনোদা নগেন্দ্ৰ-কর্তৃক এই অবমাননায় ক্ৰোধে ক্ষোভে লাজায় অধীর হইয়া নিজের হাত ছাড়াইবার জন্য টানাটানি করিতেছে এমন সময় তাহদের দৃষ্টিগোচর হইল, ঘরে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন হইয়াছে। নগেন্দ্ৰ নতমুখে ঘর হইতে বাহির হইবার পথ অন্বেষণ করিতে লাগিল । পরিচারিকা গভীরস্বরে কহিল, “বউঠাকরুন, তোমাকে পিসিমা ডাকছেন।” বিনোদ ছলছল চক্ষে নগেন্দ্রের প্রতি বিদ্যুৎকটাক্ষ বর্ষণ করিয়া দাসীর সঙ্গে চলিয়া গেল । পরিচারিকা যেটুকু দেখিয়ছিল তাহাকে হ্রস্ব এবং যাহা না দেখিয়াছিল তাহাকেই সুদীর্ঘতর করিয়া বৈদ্যনাথের অন্তঃপুরে একটা ঝড় তুলিয়া দিল । বিনোদার কী দশা হইল সে কথা বর্ণনার অপেক্ষা কল্পনা সহজ । সে যে কতদূর নিরপরাধ কাহাকেও বুঝাইতে চেষ্টা করিল না, নতমুখে সমস্ত সহিয়া গেল । বৈদ্যনাথ আপন ভাবী পিণ্ডদাতার আবির্ভাবসন্তাবনা অত্যন্ত সংশায়াচ্ছন্ন জ্ঞান করিয়া বিনোদকে কহিল, “কলঙ্কিনী, তুই আমার ঘর হইতে দূর হইয়া যা ।” বিনোদা শয়নকক্ষের দ্বার রোধ করিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল, তাহার অশ্রুহীন চক্ষু মধ্যাহ্নের মরুভূমির মতো জ্বলিতেছিল। যখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হইয়া বাহিরের বাগানে কাকের ডাক থামিয়া গেল, তখন নক্ষত্ৰখচিত শান্ত আকাশের দিকে চাহিয়া তাহার ব্যাপম্যায়ের কথা মনে পড়িল এবং তখন দুই গণ্ড দিয়া অশ্রু বিগলিত হইয়া পড়িতে লাগিল । সেই রাত্রে বিনোদা স্বামীগৃহ ত্যাগ করিয়া গেল। কেহ তাহার খোজও করিল না। তাঙ্গন বিনোদ জানিত না যে, “প্ৰজনাৰ্থং মহাভাগা শ্ৰী-জন্মের মহাভাগ্য সে লাভ করিয়াছে, তাহার স্বামীর পারলৌকিক সদগতি তাহার গর্তে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে।