পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se WS (2 মধ্যে রান্নাবাটিনা, গৃহকাৰ্য, পরীক্ষার পাঠ, তাসদাবার বৈঠক, দাম্পত্য কলহ, বড়োজের ভ্ৰাতৃবিচ্ছেদ এবং মকদ্দমার পরামর্শ ছাড়া বিশেষ কিছু নাই- কোনো-একটা বাড়ির দিকে চাহিয়া কখনো এ কথা মনে হয় না যে, হয়তো এই মুহুর্তেই এই গৃহের কোনো-একটা কোণে শয়তান মুখ গুজিয়া বসিয়া আপনার কালো কালো ডিমগুলিতে তা দিতেছে । আমি অনেক সময়ই রান্তায় বাহির হইয়া পথিকদের মুখ এবং চলনের ভাব পর্যবেক্ষণ করিতাম ; ভাবে ভঙ্গিতে যাহাদিগকে কিছুমাত্র সন্দেহজনক বোধ হইয়াছে আমি অনেক সময়ই গোপনে তাহদের অনুসরণ করিয়াছি, তাহাদের নামধাম ইতিহাস অনুসন্ধান করিয়াছি, অবশেষে পরম নৈরাশ্যের সহিত পআবিষ্কার করিয়াছি- তাহারা নিষ্কলঙ্ক ভালোমানুষ, এমন-কি, তাহদের আত্মীয়-বান্ধবেরাও তাদের সম্বন্ধে আড়ালে কোনোপ্রকার গুরুতর মিথ্যা অপবাদও প্রচার করে না । পথিকদের মধ্যে সব চেয়ে যাহাকে পাষণ্ড বলিয়া মনে হইয়াছে, এমন-কি, যাহাকে দেখিয়া নিশ্চয় মনে করিয়াছি যে, এইমাত্র সে কোনো একটা উৎকট দুইেকার্য সাধন করিয়া আসিয়াছে, সন্ধান করিয়া জানিয়াছি- সে একটি ছাত্রবৃত্তি স্কুলের দ্বিতীয় পণ্ডিত, তখনই অধ্যাপনকার্য সমাধা করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিতেছে। এই-সকল লোকেরাই অন্য-কোনো দেশে জন্মগ্রহণ করিলে বিখ্যাত চোরাডাকাত হইয়া উঠিতে পারিত, কেবলমাত্র যথোচিত জীবনীশক্তি এবং যথেষ্ট পরিমাণ পৌরুষের অভাবেই আমাদের দেশে ইহারা কেবল পণ্ডিতি করিয়া বৃদ্ধিবয়সে পেন্সন লইয়া মরে ; বহু চেষ্টা ও সন্ধানের পর এই দ্বিতীয় পণ্ডিতটার নিরীহতার প্রতি আমার যেরূপ সুগভীর অশ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল কোনো অতিক্ষুদ্র ঘটিবাটি-চোরের প্রতি তেমন হয় নাই । অবশেষে একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাদেরই বাসার অনতিদূরে একটি গ্যাসপোস্টের নীচে একটা মানুষ দেখিলাম, বিনা আবশ্যকে সে উৎসুকভাবে একই স্থানে ঘুরিতেছে ফিরিতেছে। তাহাকে দেখিয়া আমার সন্দেহমাত্র রহিল না যে, সে একটি-কোনো গোপন দূরভিসন্ধির পশ্চাতে নিযুক্ত রহিয়াছে। নিজে অন্ধকারে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া তাহার চেহারাখানা বেশ ভালো করিয়া দেখিয়া লইলাম- তরুণ বয়স, দেখিতে সুশ্ৰী ; আমি মনে মনে কহিলাম, দুকর্ম করিবার এই তো ঠিক উপযুক্ত চেহারা ; নিজের মুখশ্ৰীই যাহাঁদের সর্বপ্রধান বিরুদ্ধ সাক্ষী তাহারা যেন সর্বপ্রকার অপরাধের কাজ সর্বপ্রযত্নে পরিহার করে ; সৎকাৰ্য করিয়া তাহারা নিস্ফল হইতে পারে, কিন্তু দুষ্কর্ম দ্বারা সফলতা লাভও তাঁহাদের পক্ষে দুরাশা। দেখিলাম, এই ছোকরাটির চেহারাটাই ইহার সর্বপ্রধান বাহাদুরি ; সেজন্য আমি মনে মনে অনেকক্ষণ ধরিয়া তাহার তারিফ করিলাম ; বলিলাম, 'ভগবান তোমাকে যে দুর্লভ সুবিধাটি দিয়াছেন সেটাকে রীতিমত কাজে খাটাইতে পাের, তবে তো বলি শাবাশ ।” আমি অন্ধকার হইতে তাহার সম্মুখে আসিয়াই পৃষ্ঠে চপেটাঘাতপূর্বক বলিলাম, “এই যে, ভালো আছেন তো ?” সে তৎক্ষণাৎ প্রবলমাত্রায় চমকিয়া উঠিয়া একেবারে ফ্যাকাশে হইয়া উঠিল । আমি কহিলাম, “মাপ করিবেন, ভুল হইয়াছে, হঠাৎ আপনাকে অন্য লোক ঠাওরাইয়াছিলাম।” মনে মনে কহিলাম কিছুমাত্র ভুল করি নাই, যাহা ঠাওরাইয়াছিলাম তাই বটে ।' কিন্তু এতটা অধিক চমকিয়া ওঠা তাহার পক্ষে অনুপযুক্ত হইয়াছিল, ইহাতে আমি কিছু ক্ষুব্ধ হইলাম। নিজের শরীরের প্রতি তাহার আরো অধিক দখল থাকা উচিত ছিল ; কিন্তু শ্রেষ্ঠতার সম্পূর্ণ আদর্শ অপরাধী শ্রেণীর মধ্যেও বিরল। চোরকেও সেরা চোর করিয়া তুলিতে প্ৰকৃতি কৃপণতা করিয়া থাকে । অন্তরালে আসিয়া দেখিলাম, সে ত্রান্তভাবে গ্যাসপোস্ট ছাড়িয়া চলিয়া গেল । পিছনে পিছনে গেলাম ; দেখিলাম, ছোকরাটি গোলদিঘির মধ্যে প্রবেশ করিয়া পুষ্করিণীতীরে তৃণশয্যার উপর চিত হইয়া শুইয়া পড়িল ; আমি ভাবিলাম, উপায়চিন্তার এ একটা স্থান বটে, গ্যাসপোস্টের তলদেশ অপেক্ষা অনেকাংশে ভালো- লোকে যদি কিছু সন্দেহ করে তো বড়েজোর এই ভাবিতে পারে যে, হোকরাটি অন্ধকার আকাশে প্ৰেয়সীর মুখচন্দ্র অঙ্কিত করিয়া কৃষ্ণপক্ষ রাত্রির অভাব পূরণ করিতেছে। ছেলেটির প্রতি উত্তরোত্তর আমার চিত্ত আকৃষ্ট হইতে লাগিল । অনুসন্ধান করিয়া তাহার বাসা জানিলাম। মন্মথ তাহার নাম, সে কলেজের ছাত্র, পরীক্ষা ফেল করিয়া গ্ৰীষ্মাবকাশে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, তাহার বাসার সহবাসী ছাত্ৰগণ সকলেই আপনি আপন SSSS