পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܛ ܐ বাড়ি চলিয়া গেছে। দীর্ঘ অবকাশকালে সকল ছাত্রই বাসা ছাড়িয়া পালায়, এই লোকটিকে কোন দুট্টগ্রহ ছুটি দিতেছে না সেটা বাহির করিতে কৃতসংকল্প হইলাম। আমিও ছাত্ৰ সাজিয়া তাহার বাসায় এক অংশ গ্ৰহণ করিলাম। প্রথমদিন যখন সে আমাকে দেখিল কেমন একরকম করিয়া সে আমার মুখের দিকে চাহিল, তাহার ভাবটা ভালো বুঝিলাম না। যেন সে বিস্মিত, যেন সে আমার অভিপ্ৰায় বুঝিতে পারিয়াছে, এমনি একটা ভাব । বুঝিলাম, শিকারীর উপযুক্ত শিকার বটে, ইহাকে সোজাভাবে ফস করিয়া কায়দা করা যাইবে না। অথচ যখন তাহার সহিত প্ৰণয়বন্ধনের চেষ্টা করিলাম তখন সে ধরা দিতে কিছুমাত্র বিধা করিল না। কিন্তু মনে হইল, সেও আমাকে সুতীক্ষ দৃষ্টিতে দেখে, সেও আমাকে চিনিতে চায়। মনুষ্যচরিত্রের প্রতি এইরূপ সদাসতর্ক সজাগ কৌতুহল, ইহা ওন্তাদের লক্ষণ। এত অল্প বয়সে এতটা চাতুরী দেখিয়া বড়ো খুশি হইলাম । মনে ভাবিলাম, মাঝখানে একজন রমণী না আনিলে এই অসাধারণ অকালাধূর্ত ছেলেটির হৃদয়ত্বার উদঘাটন করা সহজ হইবে না । একদিন গদগদকণ্ঠে মন্মথকে বলিলাম, “ভাই, একটি স্ত্রীলোককে আমি ভালোবাসি, কিন্তু সে उ. एख्या ना !” প্রথমটা সে যেন কিছু চকিতভাবে আমার মুখের দিকে চাহিল, তাহার পর ঈষৎ হাসিয়া কহিল, “এরূপ দুৰ্যোগ বিরল নহে। এইপ্ৰকার মজা করিবার জন্যই কৌতুকপর বিধাতা নরনারীর প্রভেদ করিয়াছেন ।” আমি কহিলাম, “তোমার পরামর্শ ও সাহায্য চাহি ।” সে সম্মত হইল । আমি বানাইয়া বানাইয়া অনেক ইতিহাস কহিলাম ; সে সাগ্রহে কৌতুহলে সমস্ত কথা শুনিল, কিন্তু অধিক কথা কহিল না । আমার ধারণা ছিল, ভালোবাসার বিশেষত গৰ্হিত ভালোবাসার, ব্যাপার প্রকাশ করিয়া বলিলে মানুষের মধ্যে অন্তরঙ্গতা দ্রুত বাড়িয়া উঠে ; কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে তাহার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, ছোকরাটি পূর্বাপেক্ষা যেন চুপ মারিয়া গেল, অথচ সকল কথা মনে গাঁথিয়া লইল । ছেলেটির প্রতি আমার ভক্তির সীমা রহিল না । এ দিকে মন্মথ প্রত্যহ গোপনে দ্বার রোধ করিয়া কী করে, এবং তার গোপন অভিসন্ধি কিরূপে কতদূর অগ্রসর হইতেছে আমি তাহার ঠিকানা করিতে পারিলাম না, অথচ অগ্রসর হইতেছিল তাহার সন্দেহ নাই। কী একটা নিগৃঢ় ব্যাপারে সে ব্যাপৃত আছে এবং সম্প্রতি সেটা অত্যন্ত পরিপাক হইয়াছে, তাহা এই নবযুবকটির মুখ দেখিবামাত্র বুঝা যাইত। আমি গোপন চাবিতে তাহার ডেস্ক খুলিয়া দেখিয়াছি, তাহাতে একটা অত্যন্ত দুর্বোিধ কবিতার খাতা, কলেজের বক্তৃতার নোট এবং বাড়ির লোকের গোটকতক অকিঞ্চিৎকর চিঠি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় নাই। কেবল বাড়ির চিঠি হইতে এই প্রমাণ হইয়াছে যে, বাড়ি ফিরিবার জন্য আত্মীয়স্বজন বারংবার প্রবল অনুরোধ করিয়াছে ; তথাপি, তৎসত্ত্বেও বাড়ি না। যাইবার একটা সংগত কারণ অবশ্য আছে ; সেটা যদি ন্যায়সংগত হইত। তবে নিশ্চয় কথায় কথায় এতদিনে ফাস হইত, কিন্তু তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত হইবার সম্ভাবনা থাকাতেই এই ছোকরাটির গতিবিধি এবং ইতিহাস আমার কাছে এমন নিরতিশয় ঔৎসুক্যজনক হইয়াছে- যে অসামাজিক মনুষ্যসম্প্রদায় পাতালতলে সম্পূর্ণ আত্মগোপন করিয়া এই বৃহৎ মনুষ্যসমাজকে সর্বদাই নীচের দিক হইতে দোলায়মান করিয়া রাখিয়ছে, এই বালকটি সেই বিশ্বব্যাপী বহুপুরাতন বৃহৎজাতির একটি অঙ্গ, এ সামান্য একজন স্কুলের ছাত্র নহে ; এ জগৎবক্ষবিহারিণী সর্বনাশিনীর একটি প্ৰলয়সহচর ; আধুনিককালের চশমাপরা নিরীহ বাঙালি ছাত্রের বেশে কলেজের পাঠ অধ্যয়ন করিতেছে, নৃমুণ্ডধারী কাপালিক বেশে ইহুর ভৈরবতা আমার নিকট আরো ভৈরবতার হুইত না ; আমি ইহাকে ভক্তি করি । অবশেষে সশরীরে রমণীর অবতারণা করিতে হইল । পুলিসের বেতনভোগী হরিমতি আমার সহায় হইল। মন্মথকে জানাইলাম, আমি এই হরিমতির হতভাগ্য প্রণয়াকাঙক্ষী, ইহাকে লক্ষ্য করিয়াই আমি