পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

KOS) r রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী । সেদিন সন্ধ্যায় পূর্বভাগে আমার বাসায় থাকিবার কথা ছিল না। কিন্তু আমি সেদিন গায়ে পড়িয়া নানা কথা পাড়িয়া বৈকালের দিকে কিছুতেই আর উঠিবার গা করিলাম না। মন্মথ মনে মনে অস্থির হইয়া উঠিতে লাগিল, আমার সকল মতের সঙ্গেই সে সম্পূর্ণ সম্মতি প্রকাশ করিল, কোনাে তর্কের কিছুমাত্র প্রতিবাদ করিল না। অবশেষে ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ব্যাকুলচিত্তে উঠিয়া দাড়াইয়া কহিল, “হরিমতিকে আজ আনিতে যাইবে না ?” আমি সচকিত ভাবে কহিলাম, “হা হা, সে কথা ভুলিয়া গিয়াছিলাম। তুমি, ভাই, আহারাদি প্রস্তুত করিয়া রাখো, আমি ঠিক সাড়ে দশটা রাত্রে তাহাকে। এখানে আনিয়া উপস্থিত করিব।” এই বলিয়া চলিয়া গেলাম । আনন্দের নেশা আমার সর্বশরীরের রক্তের মধ্যে সঞ্চারণ করিতে লাগিল । সন্ধ্যা সাত ঘটিকার প্ৰতি মন্মথের যে প্রকার ঔৎসুক্য দেখিলাম আমার ঔৎসুক্য তদপেক্ষা অল্প ছিল না, আমি আমাদের বাসার অনতিদূরে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া প্ৰেয়সীসমাগমোৎকণ্ঠিত প্রণয়ীর ন্যায় মুহুর্মুহু ঘড়ি দেখিতে লাগিলাম। গোধূলির অন্ধকার ঘনীভূত হইয়া যখন রাজপথে গ্যাস জ্বালিবার সময় হইল এমন সময় একটি রুদ্ধদ্বার পালকি আমাদের বাসার মধ্যে প্রবেশ করিল। ঐ আচ্ছন্ন পালকিটির মধ্যে একটি অশ্রুসিক্ত অবগুষ্ঠিত পাপ, একটি মূর্তিমতী ট্র্যাজেডি কলেজের ছাত্রনিবাসের মধ্যে গুটিকতক উড়ে করিয়া আমার সর্বশরীরে অপূর্ব পুলকসঞ্চার হইল । আমি আর অধিক বিলম্ব করিতে পারিলাম না । অনতিকাল পরে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বাহিয়া দোতলায় উঠিলাম। ইচ্ছা ছিল গোপনে লুকাইয়া দেখিয়া শুনিয়া লইব, কিন্তু তাহা ঘটিল না ; কারণ, সিঁড়ির সম্মুখবতী ঘরেই সিঁড়ির দিকে মুখ করিয়া মন্মথ বসিয়াছিল, এবং গৃহের অপর প্রান্তে বিপরীতমুখে একটি অবগুষ্ঠিতা নারী বসিয়া মৃদুস্বরে কথা কহিতেছিল। যখন দেখিলাম মন্মথ আমাকে দেখিতে । পাইয়াছে, তখন দ্রুত ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই বলিলাম, “ভাই, আমার ঘড়িটা ঘরে ফেলিয়া আসিয়াছি, তাই লইতে আসিলাম ।” মন্মথ এমনি অভিভূত হইয়া পড়িল যে, বোধ হইল যেন তখনই সে মাটিতে পড়িয়া যাইবে । আমি কৌতুক এবং আনন্দে নিরতিশয় ব্যগ্ৰ হইয়া উঠিলাম ; বলিলাম, “ভাই, তোমার অসুখ করিয়াছে না কি ” সে কোনো উত্তর দিতে পারিল না । তখন সেই কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ আড়ষ্ট অবগুষ্ঠিত নারীর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি মন্মথর কে হন ।” কোনো উত্তর পাইলাম না, কিন্তু দেখিলাম। তিনি মন্মথর কেহই হন না, আমারই স্ত্রী হন । তাহার পর কী হইল সকলে জানেন । এই আমার ডিটেকটিভ-পদের প্রথম চোর ধরা । আমি কিয়ৎক্ষণ পরে ডিটেকটিভ মহিমচন্দ্ৰকে কহিলাম, “মন্মথর সহিত তোমার স্ত্রীর সম্বন্ধ সমাজবিরুদ্ধ না হইতেও পারে ।” মহিম কহিল, “না হইবারই সম্ভব । আমার স্ত্রীর বাক্স হইতে মন্মথর এই চিঠিখানি পাওয়া গেছে ।” বলিয়া একখানি চিঠি আমার হাতে দিল ; সেখানি নিজে প্ৰকাশিত হইল সুচরিতাসু, হতভাগ্য মন্মথের কথা তুমি বোধ করি এতদিনে ভুলিয়া গিয়াছ। বাল্যকালে যখন কাজিবাড়ির মাতুলালয়ে যাইতাম, তখন সর্বদাই সেখান হইতে তোমাদের বাড়ি গিয়া তোমার সহিত অনেক খেলা করিয়াছি। আমাদের সে খেলাঘর এবং সে খেলার সম্পর্ক ভাঙিয়া গেছে। তুমি জােন কি না বলিতে পারি না, একসময় ধৈর্যের বাধ ভাঙিয়া এবং লেজার মাথা খাইয়া তোমার সহিত আমার বিৰাহের সম্বন্ধ-চেষ্টাও করিয়াছিলাম, কিন্তু আমাদের বয়স প্রায় এক বলিয়া উভয় পক্ষেরই কর্তারা কোনোক্রমে রাজি হইলেন না । তাহার পর তোমার বিবাহ হইয়া গেলে চার-পাঁচ বৎসর তোমার আর কোনো সন্ধান পাই নাই । আজ পাচ মাস হইল তোমার স্বামী কলিকাতার পুলিসের কর্ম লইয়া শহরে বদলি হইয়াছেন, খবর