পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SD NR NR রবীন্দ্র-রচনাবলী মুখে আমার হাত চাপিয়া ধরিয়া বিস্ফারিত নেত্র আমার মুখের প্রতি স্থাপন করিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “যাও, ভাই, অমর কীর্তি অক্ষয় গৌরব অর্জন করিয়া আইস ।” আমার শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল ; মনে হইল, যেন আসন্নগৌরবগর্বিত ভক্তিবিহবল বঙ্গদেশের প্রতিনিধি হইয়া অমূল্য এই কথাগুলি আমাকে বলিল । অমূল্যও বড়ো কম ত্যাগাস্বীকার করিল না ; সে স্বদেশের হিতের জন্য সুদীর্ঘ একমাসকাল আমার সঙ্গপ্রত্যাশা সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন করিল। সুগভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া আমার বন্ধু ট্রামে চড়িয়া তাহার কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের বাসায় চলিয়া গেল, আমি গঙ্গার ধারে ফরাসডাঙার বাগানে অমর কীর্তি অক্ষয় গৌরব উপাৰ্জন করিতে গেলাম । গঙ্গার ধারে নির্জন ঘরে চিত হইয়া শুইয়া বিশ্বজনীন প্রেমের কথা ভাবিতে ভাবিতে মধ্যাহ্নে প্ৰগাঢ় নিদ্রাবেশ হইত, একেবারে অপরাহুে পাচটার সময় জাগিয়া উঠিতাম । তাহার পর শরীর মনটা কিছু অবসাদগ্ৰস্ত হইয়া থাকিত ; কোনোমতে চিত্তবিনোদন ও সময়ব্যাপনের জন্য বাগানের পশ্চাদিকে রাজপথের ধারে একটা ছোটাে কাষ্ঠাসনে বসিয়া চুপচাপ করিয়া গোরুর গাড়ি ও লোক-চলাচল দেখিতাম । নিতান্ত অসহ্য হইলে স্টেশনে গিয়া বসিতাম, টেলিগ্রাফের কাটা কটকট শব্দ করিত, টিকিটের ঘণ্টা বাজিত, লোকসমাগম হইত, রক্তচক্ষু সহস্রপদ লৌহসরীসৃপ ফুসিতে যুঁসিতে আসিত, উৎকট চীৎকার করিয়া চলিয়া যাইত, লোকজনের হুড়ামুড়ি পড়িত, কিয়ৎক্ষণের জন্য কৌতুকবোধ করিতাম । বাড়ি ফিরিয়া, আহার করিয়া, সঙ্গী অভাবে সকাল-সকাল শুইয়া পড়িতাম, এবং প্ৰাতঃকালে সকাল-সকাল উঠিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন না থাকাতে বেলা আট-নয়টা পর্যন্ত বিছানায় যাপন করিতাম । শরীর মাটি হইল, বিশ্বপ্রেমেরও কোনো অন্ধিসন্ধি খুঁজিয়া পাইলাম না । কোনোকালে একা থাকা অভ্যাস না থাকাতে সঙ্গীহীন গঙ্গাতীর শূন্য শ্মশানের মতো বোধ হইতে লাগিল ; অমূল্যাটাও এমনি গর্দভ যে, একদিনের জন্যও সে আপন প্ৰতিজ্ঞা ভঙ্গ করিল না । ইতিপূর্বে কলিকাতায় বসিয়া ভাবিতাম, বিপুলচ্ছায়া বটবৃক্ষের তলে পা ছড়াইয়া বসিব, পদপ্রান্তে কলনদিনী স্রোতস্বিনী। আপন-মনে বহিয়া চলিবে- মাঝখানে স্বপ্নবিষ্ট কবি, এবং চারি দিকে তাহার ভাব রাজ্য ও বহিঃপ্রকৃতি— কাননে পুষ্প, শাখায় বিহঙ্গ, আকাশে তারা, মনের মধ্যে বিশ্বজনীন প্ৰেম এবং লেখনীমুখে অশ্রান্ত অজস্র ভাবস্রোত বিচিত্র ছন্দে প্রবাহিত । কিন্তু কোথায় প্রকৃতি এবং কোথায় প্রকৃতির কবি, কোথায় বিশ্ব আর কোথায় বিশ্বপ্রেমিক ! একদিনের জন্যও বাগানে বাহির হই নাই। কাননের ফুল কাননে ফুটিত, আকাশের তারা আকাশে উঠিত, বটবৃক্ষের ছায়া বটবৃক্ষের তলে পড়িত, আমিও ঘরের ছেলে ঘরেই পডিয়া থাকিতাম । আমহাৰা কিছুতেই প্রমাণ করতে ন পারিয়া বামাচরণের প্রতি আকাশ বাডিয়া উঠতে 하키 | সে সময়টাতে বাল্যবিবাহ লইয়া বাঙলার শিক্ষিতসমাজে একটা বাগযুদ্ধ বাধিয়াছিল। বামাচরণ বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধ পক্ষে ছিলেন এবং পরস্পর শোনা গিয়াছিল যে তিনি একটি যুবতী কুমারীর প্ৰণয়পাশে আবদ্ধ এবং অচিরে পরিণয়পাশে বদ্ধ হইবার প্রত্যাশায় আছেন । বিষয়টা আমার কাছে অত্যন্ত কৌতুকাবহ ঠেকিয়াছিল, এবং বিশ্বপ্রেমের মহাকাব্যও ধরা দিল না, তাই বসিয়া বসিয়া বামাচরণকে নায়কের আদর্শ করিয়া কদম্বকলি মজুমদার নামক একটি কাল্পনিক যুবতীকে নায়িকা খাড়া করিয়া সুতীব্ৰ এক প্ৰহসন লিখিলাম। লেখনী এই অমর কীর্তিটি প্রসব করিবার পর আমি কলিকাতা যাত্রার উদ্যোগ করিতে লাগিলাম। এমন সময় যাত্রায় ব্যাঘাত পড়িল । তৃতীয় পরিচ্ছেদ একদিন অপরান্ধুে স্টেশনে না গিয়া অলসভাবে বাগানবাড়ির ঘরগুলি পরিদর্শন করিতেছিলাম । আবশ্যক না হওয়াতে ইতিপূর্বে অধিকাংশ ঘরে পদার্পণ করি নাই, বাহবন্ত সম্বন্ধে আমার কৌতুহল বা