পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ev OS বটবৃক্ষচ্ছায়ায় পা ছড়াইয়া দিয়া সমস্তদিন স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম, দুইখানি সুকোমল পদপল্লিবের তলে বিশ্বপ্রকৃতি মাথা নত করিয়া পড়িয়া আছে- আকাশ আলোকিত, ধরণী পুলকিত, বাতাস উতলা, তাহারই মধ্যে দুইখানি অনাবৃত চরণ স্থির নিম্পন্দ সুন্দর ; তাহারা জানেও না যে, তাহদেরই রেণুকণার মাদকতায় তপ্তযৌবন নববসন্ত দিগ্বিদিকে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে। ইতিপূর্বে প্রকৃতি আমার কাছে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন ছিল, নদী বন আকাশ সমন্তই স্বতন্ত্র ছিল। আজ সেই বিশাল বিপুল বিকীর্ণতার মাঝখানে একটি সুন্দরী প্রতিমূর্তি দেখা দিব্যমাত্র তাহা অবয়ব ধারণ করিয়া এক হইয়া উঠিয়াছে। আজ প্রকৃতি আমার কাছে এক ও সুন্দর, সে আমাকে অহরহ। মূকভাবে অনুনয় করিতেছে, “আমি মীেন, তুমি আমাকে ভাষা দেও, আমার অন্তঃকরণে যে-একটি অব্যক্ত স্তব উখিত হইতেছে তুমি তাহাকে ছন্দো লয়ে তানে তোমার সুন্দর মানবভাষায় ধ্বনিত করিয়া তোলো ?” প্রকৃতির। সেই নীরব অনুনয়ে আমার হৃদয়ের সমস্ত তন্ত্রী বাজিতে থাকে। বারংবার কেবল এই গান শুনি, “হে সুন্দরী, হে মনোহারিণী, হে বিশ্বজয়িনী, হে মনপ্ৰাণপতঙ্গের একটিমাত্র দীপশিখা, হে অপরিসীম জীবন, হে অনন্তমধুর মৃত্যু !” এ গান শেষ করিতে পারি না, সংলগ্ন করিতে পারি না ; ইহাকে আকারে পরিস্ফুট করিতে পারি না, ইহাকে ছন্দে গাঁথিয়া ব্যক্ত করিয়া বলিতে পারি না ; মনে হয়, আমার অন্তরের মধ্যে জোয়ারের জলের মতো একটা অনির্বচনীয় অপরিমেয় শক্তির সঞ্চার হইতেছে, এখনো তাহাকে আয়ত্ত করিতে পারিতেছি না, যখন পারিব তখন আমার কণ্ঠ অকস্মাৎ দিব্য সংগীতে ধ্বনিত, আমার ললাট অলৌকিক আভায় আলোকিত হইয়া উঠিবে। এমন সময় একটি নীেকা পরপারের নৈহাটি স্টেশন হইতে পার হইয়া আমার বাগানের ঘাটে আসিয়া লাগিল। দুই স্কন্ধের উপরে কেঁচানো চাদর বুলাইয়া ছাতাটি কক্ষে লইয়া হাস্যমুখে অমূল্য নামিয়া পড়িল । অকস্মাৎ বন্ধুকে দেখিয়া আমার মনে যেরূপ ভাবোদয় হইল, আশা করি, শত্রুর প্রতিও কাহারও যেন সেইরূপ না ঘটে । বেলা প্ৰায় দুইটার সময় আমাকে সেই বটের ছায়ায় নিতান্ত ক্ষিপ্তের মতো বসিয়া থাকিতে দেখিয়া অমূল্যর মনে ভারি একটা আশার সঞ্চার হইল। পাছে বঙ্গদেশের ভবিষ্যৎ সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যের কোনো-একটা অংশ তাহার পদশব্দে সচকিত হইয়া বন্য রাজহংসের মতো একেবারে জলের মধ্যে গিয়া পড়ে সেই ভয়ে সে সসংকোচে মৃদুমন্দগমনে আসিতে লাগিল ; দেখিয়া আমার আরো রাগ হইল, কিঞ্চিৎ অধীর হইয়া কহিলাম, “কী হে অমূল্য, ব্যাপারখানা কী ! তোমার পায়ে কাটা ফুটিল নাকি ।” অমূল্য ভাবিল, আমি খুব একটা মজার কথা বলিলাম ; হাসিতে হাসিতে কাছে আসিয়া তরুতল কোচা দিয়া বিশেষরূপে ঝাড়িয়া লইল, পকেট হইতে একটি রুমাল লইয়া ভাজ খুলিয়া বিছাইয়া তাহার উপরে সাবধানে বসিল, কহিল, “যে প্রহসনটা লিখিয়া পঠাইয়াছ সেটা পড়িয়া হাসিয়া বাচি না।” বলিয়া তাহার স্থানে স্থানে আবৃত্তি করিতে করিতে হাস্যোচ্ছাসে তাহার নিশ্বাসরোধ হইবার উপক্রম হইল। আমার এমনি মনে হইল যে, যে কলমে সেই প্ৰহসনটা লিখিয়ছিলাম, সেটা যে গাছের কাষ্ঠদণ্ডে নির্মিত সেটাকে শিকড়সুদ্ধ উৎপাটন করিয়া মন্ত একটা আগুন করিয়া প্ৰহসনটাকে ছাই করিয়া ফেলিলেও আমার খেদ মিটিবে না । অমূল্য সসংকোচে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার সে কাব্যের কতদূর ।” শুনিয়া আরও আমার গা জ্বলিতে লাগিল, মনে মনে কহিলাম, যেমন আমার কাব্য তেমনি তোমার বুদ্ধি !' মুখে কহিলাম, “সে-সব পরে হইবে ভাই, আমাকে অনর্থক ব্যস্ত করিয়া তুলিয়ে না।” অমূল্য লোকটা কৌতুহলী, চারি দিক পর্যবেক্ষণ না করিয়া সে থাকিতে পারে না, তাহার ভয়ে আমি উত্তরের দরজাটা বন্ধ করিয়া দিলাম। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “ও দিকে কী আছে হে।” আমি বলিলাম, “কিছু না !” এতবড়ো মিথ্যা কথাটা আমার জীবনে আর কখনো বলি নাই। দুটা দিন আমাকে নানা প্রকারে বিদ্ধ করিয়া, দগ্ধ করিয়া, তৃতীয় দিনের সন্ধ্যার ট্রেনে অমূল্য চলিয়া গেল। এই দুটা দিন আমি বাগানের উত্তরের দিকে যাই নাই, সে দিকে নেত্রপাতিমাত্র করি নাই, কৃপণ যেমন তাহার রত্নভাণ্ডারটি লুকাইয়া বেড়ায় আমি তেমনি করিয়া আমার উত্তরের সীমানার বাগানটি সামলাইয়া বেড়াইতেছিলাম। অমূল্য চলিয়া যাইবামাত্র একেবারে ছুটিয়া দ্বার খুলিয়া দোতলার ঘরের