পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO SRV রবীন্দ্র-রচনাবলী উত্তরের বারান্দায় বাহির হইয়া পড়িলাম। উপরে উন্মুক্ত আকাশে প্রথম কৃষ্ণপক্ষের অপর্যাপ্ত জ্যোৎস্না ; নিম্নে শাখাজালনিবন্ধ তরুশ্ৰেণীতলে খণ্ডকিরণখচিত একটি গভীর নিভৃত প্ৰদোষান্ধকার ; মৰ্মরিত ঘনপল্লবের দীর্ঘনিশ্বাসে, তরুতলবিদ্যুত বকুলফুলের নিবিড় সৌরভে এবং সন্ধারণ্যের স্ততিত সংযত নিঃশব্দতায় তাহা রোমে রোমে পরিপূর্ণ হইয়াছিল । তাহারই মাঝখানটিতে আমার কুমারী প্রতিবেশিনী তাহার খেতৰ্ম্মশ্র বৃদ্ধ পিতার দক্ষিণ হস্ত ধরিয়া ধীরে ধীরে পদচারণা করিতে করিতে কী কথা কহিতেছিল- বৃদ্ধ সস্নেহে। অথচ শ্রদ্ধাভরে ঈষৎ অবনমিত হইয়া নীরবে মনোযোগসহকারে শুনিতেছিলেন । এই পবিত্র স্নিগ্ধ বিশ্ৰাম্ভালপে ব্যাঘাত করিবার কিছুই ছিল না, সন্ধ্যাকালের শান্ত নদীতে কাচিৎ দাড়ের শব্দ সুদূরে বিলীন হইতেছিল এবং অবিরল তরুশাখার অসংখ্য নীড়ে দুটি-একটি পাখি দৈবাৎ ক্ষণিক মৃদুকাকলিতে জাগিয়া উঠিতেছিল। আমার অন্তঃকরণ আনন্দে অথবা বেদনায় যেন বিদীর্ণ হইবে মনে হইল। আমার অস্তিত্ব যেন প্রসারিত হইয়া সে ছায়ালোকবিচিত্র ধরণীতলের সহিত এক হইয়া গেল, আমি যেন আমার বক্ষঃস্থলের উপর ধীরবিক্ষিপ্ত পদচারণা অনুভব করিতে লাগিলাম, যেন তরুপল্লবের সহিত সংলগ্ন হইয়া গিয়া আমার কানের কাছে মধুর মৃদুগুঞ্জনধ্বনি শুনিতে পাইলাম। এই বিশাল মূঢ় প্রকৃতির অন্তর্বেদনা যেন আমার সর্বশরীরের অস্থিগুলির মধ্যে কুহরিত হইয়া উঠিল ; আমি যেন বুঝিতে পারিলাম, ধরণী পায়ের নীচে পড়িয়া থাকে, অথচ পা জড়াইয়া ধরিতে পারে না বলিয়া ভিতরে ভিতরে কেমন করিতে থাকে, নতশাখা বনস্পতিগুলি কথা শুনিতে পায় অথচ কিছুই বুঝিতে পারে না বলিয়া সমস্ত শাখায় পল্লবে মিলিয়া কেমন উর্ধর্বশ্বাসে উন্মাদ কলশব্দে হাহাকার করিয়া উঠিতে চাহে । আমিও আমার সর্বাঙ্গে সর্বািন্তঃকরণে ঐ পদবিক্ষেপ, ঐ বিশ্রাম্ভালাপ, অব্যবহিতভাবে অনুভব করিতে লাগিলাম। কিন্তু কোনোমতেই ধরিতে পারিলাম না বলিয়া কুরিয়া কুরিয়া মরিতে লাগিলাম । পরদিনে আমি আর থাকিতে পারিলাম না । প্ৰাতঃকালে আমার প্রতিবেশীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলাম । ভবনাথবাবু তখন বড়ো এক পেয়ালা চা পাশে রাখিয়া চোখে চশমা দিয়া নীলপেন্সিলে-দাগ-করা একখানা হ্যামিলটনের পুরাতন পুঁথি মনোযোগ দিয়া পড়িতেছিলেন । আমি ঘরে প্রবেশ করিলে চশমার উপরিভাগ হইতে আমাকে কিয়ৎক্ষণ অন্যমনস্কভাবে দেখিলেন, বই হইতে মনটাকে এক মুহুর্তে প্রত্যাহরণ করিতে পারিলেন না। অবশেষে অকস্মাৎ সচকিত হইয়া ত্ৰান্তভাবে আতিথ্যের জন্য প্ৰস্তুত হইয়া উঠিলেন । আমি সংক্ষেপে আত্মপরিচয় দিলাম । তিনি এমনি শশব্যন্ত হইয়া উঠিলেন যে চশমার খাপ খুঁজিয়া পাইলেন না। খামিকা বলিলেন, “আপনি চা খাইবেন ?” আমি যদিচ চা খাই না, তথাপি বলিলাম, “আপত্তি নাই।” ভাবনাথবাবু ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া “কিরণ “কিরণ বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন । দ্বারের নিকট অত্যন্ত মধুর শব্দ শুনিলাম, “কী, বাবা।” ফিরিয়া দেখিলাম, তাপসকশ্বন্দুহিতা সহসা আমাকে দেখিয়া ত্ৰান্ত হরিণীর মতো পলায়নোদ্যতা হইয়াছেন। ভবনাথবাবু র্তাহাকে ফিরিয়া ডাকিলেন ; আমার পরিচয় দিয়া কহিলেন, “ইনি আমাদের প্রতিবেশী মহীন্দ্ৰকুমার বাবু।” এবং আমাকে কহিলেন, “ইনি আমার কন্যা কিরণবালা ।” আমি কী করিব ভাবিয়া পাইতেছিলাম না, ইতিমধ্যে কিরণ আমাকে আনভ্ৰসুন্দর নমস্কার করিলেন । আমি তাড়াতাড়ি ত্রুটি সারিয়া লইয়া তাহা শোধ করিয়া দিলাম। ভবনাথবাবু কহিলেন, “মা, মহীন্দ্রবাবুর জন্য এক পেয়ালা চা আনিয়া দিতে হইবে।” আমি মনে মনে অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া উঠিলাম। কিন্তু মুখ ফুটিয়া কিছু বলিবার পূর্বেই কিরণ ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন । আমার মনে হইল, যেন কৈলাসে সনাতন ভোলানাথ তাহার কন্যা স্বয়ং লক্ষ্মীকে অতিথির জন্য এক পেয়ালা চা আনিতে বলিলেন ; অতিথির পক্ষে সে নিশ্চয়ই অমিশ্র অমৃত হইবে, কিন্তু তবু, কাছাকাছি নদী ভৃঙ্গী কোনো বেটাই কি হাজির ছিল না। চতুর্থ পরিচ্ছেদ ভবনাথবাবুর বাড়ি আমি এখন নিত্য অতিথি । পূর্বে চা জিনিসটাকে অত্যন্ত ডরাইতাম, এক্ষণে সকালে বিকালে চা খাইয়া খাইয়া আমার চায়ের নেশা ধরিয়া গেল ।