পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

1.e. &SR আমাদের বি. এ. পরীক্ষার জন্য জার্মানপণ্ডিত-বিরচিত দর্শনশান্ত্রের নব্য-ইতিহাস আমি সদ্য পাঠ করিয়া আসিয়াছিলাম, তদুপলক্ষে ভাবনাথবাবুর সহিত কেবল দৰ্শন-আলোচনার জন্যই আসিতাম, কিছুদিন এইপ্ৰকার ভান করিলাম। তিনি হ্যামিলটন প্রভৃতি কতকগুলি সেকাল-প্রচলিত ভ্ৰান্ত পুঁথি লইয়া এখনো নিযুক্ত রহিয়াছেন, ইহাতে র্তাহাকে আমি কৃপাপাত্ৰ মনে করিতাম, এবং আমার নূতন বিদ্যা অত্যন্ত আড়ম্বরের সহিত জাহির করিতে ছাড়িতাম না । ভবনাথবাবু এমনি ভালোমানুষ, এমনি সকল বিষয়ে সসংকোচ যে, আমার মতো অল্পবয়স্ক যুবকের মুখ হইতেও সকল কথা মানিয়া যাইতেন, তিলমাত্র প্রতিবাদ করিতে হইলে অস্থির হইয়া উঠিতেন, ভয় করিতেন পাছে আমি কিছুতে ক্ষুদ্ৰ হই । কিরণ আমাদের এই সকল তত্ত্বালোচনার মাঝখান হইতেই কোনো ছুতায় উঠিয়া চলিয়া যাইত । তাহাতে আমার যেমন ক্ষোভ জন্মিত তেমনি আমি গর্বও অনুভব করিতাম। আমাদের আলোচ্য বিষয়ের দুরূহ পাণ্ডিত্য কিরণের পক্ষে দুঃসহ ; সে যখন মনে মনে আমার বিদ্যাপর্বতের পরিমাপ করিত তখন তাহকে কত উচেই চাহিতে হইত । কিরণকে যখন দূর হইতে দেখিতাম তখন তাহাকে শকুন্তলা দময়ন্তী প্রভৃতি বিচিত্র নামে এবং বিচিত্ৰ ভাবে জানিতাম, এখন ঘরের মধ্যে তাহকে "কিরণ বলিয়া জানিলাম, এখন আর সে জগতের বিচিত্র নায়িকার ছায়ারূপিণী নহে, এখন সে একমাত্র কিরণ । এখন সে শতশতাব্দীর কাব্যলোক হইতে অবতীর্ণ হইয়া, অনন্তকালের যুবকচিত্তের স্বল্পস্বৰ্গ পরিহার করিয়া, একটি নির্দিষ্ট বাঙালিঘরের মধ্যে কুমারী-কন্যারূপে বিরাজ করিতেছে। সে আমারই মাতৃভাষায় আমার সঙ্গে অত্যন্ত সাধারণ ঘরের কথা বলিয়া থাকে, সামান্য কথায় সরলভাবে হাসিয়া উঠে, সে আমাদেরই ঘরের মেয়ের মতো দুই হাতে দুটি সোনার বালা পরিয়া থাকে, গলার হারটি বেশি কিছু নয়। কিন্তু বড়ো সুমিষ্ট, শাড়ির প্রান্তটি কখনো কবরীর উপরিভাগ বাকিয়া বেষ্টন করিয়া আসে কখনো-বা পিতৃগৃহের অনভ্যাসবশত চু্যত হইয়া পড়িয়া যায়, ইহা আমার কাছে বড়ো আনন্দের । সে যে অকাল্পনিক, সে যে সত্য, সে যে কিরণ, সে যে তাহা ব্যতীত নহে এবং তাহার অধিক নহে, এবং যদিচ সে আমার নহে তবুও সে যে আমাদের, সেজন্য আমার অন্তঃকরণ সর্বদাই তাহার প্রতি উচ্ছসিত কৃতজ্ঞতারসে অভিষিক্ত হইতে থাকে। একদিন জ্ঞানমাত্রেরই আপেক্ষিকতা লইয়া ভাবনাথবাবুর নিকট অত্যন্ত উৎসাহসহকারে বাচালতা প্রকাশ করিতেছিলাম ; আলোচনা কিয়দদূর অগ্রসর হইবামাত্র কিরণ উঠিয়া গেল এবং অনতিকাল পরেই সম্মুখের বারান্দায় একটা তোলা। উনান এবং রাধিবার সরঞ্জাম আনিয়া রাখিয়া, ভবনাথবাবুকে ভৎসনা করিয়া বলিল, “বাবা, কেন তুমি মহীন্দ্রবাবুকে ঐ-সকল শক্ত কথা লইয়া বৃথা ককাইতেছ। আসুন মহীন্দ্রবাবু, তার চেয়ে আমার রান্নায় যোগ দিলে কাজে লাগিবে ।” ভবনাথবাবুর কোনো দোষ ছিল না, এবং কিরণ তাহা অবগত ছিল। কিন্তু ভবনাথবাবু অপরাধীর মতো অনুতপ্ত হইয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “তা বটে ! আচ্ছা ও কথাটা আর-একদিন হইবে।” এই বলিয়া নিরুদবিগ্নচিত্তে তিনি তাহার নিত্যনিয়মিত অধ্যয়নে নিযুক্ত হইলেন। আবার আর-একদিন অপরাঢ়ে আর-একটা গুরুতর কথা পাড়িয়া ভাবনাথবাবুকে ভক্তিত করিয়া দিতেছি এমন সময় ঠিক মাঝখানে আসিয়া কিরণ কহিল, “মহীন্দ্রবাবু, অবলাকে সাহায্য করিতে হইবে । দেয়ালে লতা চড়াইব, নাগাল পাইতেছি না, আপনাকে এই পেরেকগুলি মারিয়া দিতে হইবে।” আমি উৎফুল্প হইয়া উঠিয়া গেলাম, ভবনাথবাবুও প্রফুল্পমনে পড়িতে বসিলেন । এমনি প্ৰায় যখনই ভবনাথবাবুর কাছে আমি ভারী কথা পাড়িবার উপক্ৰম করি, কিরণ একটা-না-একটা কাজের ছুতা ধরিয়া ভঙ্গ করিয়া দেয়। ইহাতে আমি মনে-মনে পুলকিত হইয়া উঠিতাম, আমি বুঝিতাম যে, কিরণের কাছে আমি ধরা পড়িয়াছি ; সে কেমন করিয়া বুঝিতে পারিয়াছে যে, ভবনাথবাবুর সহিত তত্ত্বালোচনা আমার জীবনের চরম সুখ নহে। বাহ্যবস্তুর সহিত আমাদের ইন্দ্ৰিয়বোধের সম্বন্ধ নির্ণয় করিতে গিয়া যখন দুরূহ রহস্যরসাতলের মধ্যপথে অবতীর্ণ হইয়াছি। এমন সময় কিরণ আসিয়া বলিত, “মহীন্দ্রবাবু, রান্নাঘরের পাশে আমার বেগুনের খেত আপনাকে দেখাইয়া আনিগে, চলুন।”