পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

v) Sbir & রবীন্দ্র-রচনাবলী আকাশকে অসীম মনে করা কেবল আমাদের অনুমািনমাত্র, আমাদের অভিজ্ঞতা ও কল্পনাশক্তির বাহিরে কোথাও কোনো-একরূপে তাহার সীমা থাকা কিছুই অসম্ভব নহে, ইত্যাকার মন্তব্য প্রকাশ করিতেছি, এমন সময় কিরণ আসিয়া বলিত, “মহীন্দ্ৰবাবু, দুটাে আম পাকিয়াছে, আপনাকে ডাল নামাইয়া ধরিতে হইবে ।” কী উদ্ধার, কী মুক্তি ! অকূল সমুদ্রের মাঝখান হইতে এক মুহুর্তে কী সুন্দর কৃলে আসিয়া উঠিতাম। অনন্ত আকাশ ও বাহবন্তু সম্বন্ধে সংশয়জাল যতই দুশোচ্ছদ্য জটিল হউক-না কেন, কিরণের বেগুনের খেত বা আমতলা সম্বন্ধে কোনোপ্রকার দুরূহতা ও সন্দেহের লেশমাত্র ছিল না । কাব্যে বা উপন্যাসে তাহা উল্লেখযোগ্য নহে। কিন্তু জীবনে তাহা সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপের ন্যায় মনোহর। মাটিতে পা ঠেকা যে কী আরাম তাহা সে-ই জানে যে বহুক্ষণ জলের মধ্যে সাতার দিয়াছে । আমি এতদিন কল্পনায় যে প্ৰেমসমূদ্র সৃজন করিয়াছিলাম তাহা যদি সত্য হইত। তবে সেখানে চিরকাল যে কী করিয়া ভাসিয়া বেড়াইতাম তাহা বলিতে পারি না। সেখানে আকাশও অসীম, সমুদ্রও অসীম, সেখান হইতে আমাদের প্রতিদিবসের বিচিত্র জীবনযাত্রার সীমাবদ্ধ ব্যাপার একেবারে নির্বাসিত, সেখানে তুচ্ছতার লেশমাত্র নাই, সেখানে কেবল ছন্দে লয়ে সংগীতে ভােব ব্যক্ত করিতে হয়, এবং তালাইতে গেলে কোথাও তল পাওয়া যায় না । কিরণ সেখান হইতে মজমান এই হতভাগ্যের কেশপাশ ধরিয়া যখন তাহার আমতলায় তাহার বেগুনের খেতে টানিয়া তুলিল তখন পায়ের তলায় মাটি পাইয়া আমি বাচিয়া গেলাম। আমি দেখিলাম, বারান্দায় বসিয়া খিচুড়ি রাধিয়া, মই চড়িয়া দেয়ালে পেরেক মারিয়া, লেবুগাছে ঘন সবুজ পত্ররাশির মধ্য হইতে সবুজ লেবুফল সন্ধান করিতে সাহায্য করিয়া অভাবনীয় আনন্দ লাভ করা যায়, অথচ সে আনন্দলাভের জন্য কিছুমাত্র প্রয়াস পাইতে হয় না— আপনি যে কথা মুখে আসে, আপনি যে হাসি উচ্ছসিত হইয়া ওঠে, আকাশ হইতে যতটুকু আলো আসে এবং গাছ হইতে যতটুকু ছায়া পড়ে তাহাঁই যথেষ্ট । ইহা ছাড়া আমার কাছে একটি সোনার কাঠি ছিল আমার নবযৌবন, একটি পরশপাথর ছিল আমার প্ৰেম, একটি অক্ষয় কল্পতরু ছিল আমার নিজের প্রতি নিজের অক্ষুদ্র বিশ্বাস ; আমি বিজয়ী, আমি ইন্দ্র, আমার উচ্চৈঃশ্রবার পথে কোনো বাধা দেখিতে পাই নাই । কিরণ, আমার কিরণ, তাহাতে আমার সন্দেহ নাই । সে কথা এতক্ষণ স্পষ্ট করিয়া বলি নাই, কিন্তু হৃদয়ের এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত মুহুর্তের মধ্যে মহাসুখে বিদীর্ণ করিয়া সে কথা বিদ্যুতের মতো আমার সমস্ত অন্তঃকরণ ধাধিয়া ক্ষণে ক্ষণে নাচিয়া উঠিতেছিল । কিরণ, আমার কিরণ । ইতিপূর্বে আমি কোনো অন্যায়ীয়া মহিলার সংস্রবে। আসি নাই, যে নব্য-রমণীগণ শিক্ষালাভ করিয়া অবরোধের বাহিরে সঞ্চারণ করেন তাহদের রীতিনীতি আমি কিছুই অবগত নাহি ; অতএব তাহদের আচরণে কোনখানে শিষ্টতার সীমা, কোনখানে প্রেমের অধিকার, তাহা আমি কিছুই জানি না ; কিন্তু ইহাও জানি না, আমাকে কেনই বা ভালো না বাসিবে, আমি কোন অংশে নুন । কিরণ যখন আমার হাতে চায়ের পেয়ালাটি দিয়া যাইত তখন চায়ের সঙ্গে পাত্ৰভরা কিরণের ভালোবাসাও গ্রহণ করিতাম, চা-টি যখন পান করিতাম তখন মনে করিতাম, আমার গ্ৰহণ সার্থক হইল এবং কিরণেরও দান সাৰ্থক হইল। কিরণ যদি সহজ সুরে বলিত ‘মহীন্দ্রবাবু, কাল সকাল-সকাল আসবেন তো ? তাহর মধ্যে ছন্দো লয়ে বাজিয়া উঠিত কী মোহিনী জােন, বন্ধু, কী মোহিনী জান ! অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা-হেন ! আমি সহজ কথায় উত্তর করিতাম, কাল আটটার মধ্যে আসব।' তাহার মধ্যে কিরণ কি শুনিতে পাইত ন পরানপুতলি তুমি হিয়ে-মণিহার, সারবস ধন মোর সকল সংসার ।