পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

呜5两 WORR আমার সমস্তদিন এবং সমস্ত রাত্ৰি অমৃতে পূৰ্ণ হইয়া গেল। আমার সমস্ত চিন্তা এবং কল্পনা মুহুর্তে মুহুর্তে নূতন নূতন শাখাপ্রশাখা বিস্তার করিয়া লতার ন্যায় কিরণকে আমার সহিত বেষ্টন করিয়া বাধিতে লাগিল । যখন শুভ-অবসর আসিবে তখন কিরণকে কী পড়াইব, কী শিখাইব, কী শুনাইব, কী দেখাইব তাহারই অসংখ্য সংকল্পে আমার মন আচ্ছন্ন হইয়া গেল । এমন-কি, স্থির করিলাম, জর্মানপণ্ডিত-রচিত দর্শনশাস্ত্রের নব্য ইতিহাসেও যাহাতে তাহার চিত্তের ঔৎসুক্য জন্মে এমন শিক্ষা তাহাকে দিতে হইবে, নতুবা আমাকে সে সর্বতোভাবে বুঝিতে পরিবে না । ইংরাজি কাব্যসাহিত্যের সৌন্দর্যলোকে আমি তাহাকে পথ দেখাইয়া লইয়া যাইব । আমি মনে মনে হাসিলাম, কহিলাম, ‘কিরণ, তোমার আমতলা এবং বেগুনের খেত আমার কাছে নূতন রাজ্য । আমি কস্মিনকালে স্বপ্নেও জানিতাম না যে, সেখানে বেগুন এবং ঝড়ে-পড়া কাচা আমি ছাড়াও দুর্লভ অমৃতফল এত সহজে পাওয়া যায় । কিন্তু যখন সময় আসিবে তখন আমিও তোমাকে এমন এক রাজ্যে লইয়া যাইব যেখানে বেগুন ফলে না। কিন্তু তথাপি বেগুনের অভাব মুহুর্তের জন্য অনুভব করিতে হয় না । সে জ্ঞানের রাজ্য, ভাবের স্বৰ্গ ।” সূর্যস্তকালের দিগন্তবিলীন পাণ্ডুবৰ্ণ সন্ধ্যাতারা ঘনায়মান সায়াহ্নে ক্রিমেই যেমন পরিস্ফুট দীপ্তি লাভ করে, কিরণও তেমনি কিছুদিন ধরিয়া ভিতর হইতে আনন্দে লাবণ্যে নারীত্বের পূর্ণতায় যেন প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিল । সে যেন তাহার গৃহের, তাহার সংসারের ঠিক মধ্য-আকাশে অধিরোহণ করিয়া চারি দিকে আনন্দের মঙ্গল জ্যোতি বিকীর্ণ করিতে লাগিল ; সেই জ্যোতিতে তাহার বৃদ্ধ পিতার শুভ্রকেশের উপর পবিত্রতর উজ্জ্বল আভা পড়িল, এবং সেই জ্যোতি আমার উদবোেল হৃদয়সমুদ্রের প্রত্যেক তরঙ্গের উপর কিরণের মধুর নামের একটি করিয়া জ্যোতির্ময় স্বাক্ষর মুদ্রিত করিয়া দিল । এ দিকে আমার ছুটি সংক্ষিপ্ত হইয়া আসিল, বিবাহ-উদ্দেশে বাড়ি আসিবার জন্য পিতার সমেহ অনুরোধ ক্ৰমে কঠিন আদেশে পরিণত হইবার উপক্রম হইল, এ দিকে অমূল্যকেও আর ঠেকাইয়া রাখা যায় না, সে কোনদিন উন্মত্ত বন্যাহন্তীর ন্যায় আমার এই পদ্মবনের মাঝখানে ফস করিয়া তাহার বিপুল চরণচতুষ্টয় নিক্ষেপ করিবে এ উদবেগও উত্তরোত্তর প্রবল হইতে লাগিল। কেমন করিয়া অবিলম্বে অন্তরের আকাঙক্ষাকে ব্যক্ত করিয়া আমার প্রণয়কে পরিণয়ে বিকশিত করিয়া তুলিব, তাহাই ভাবিতে व्लाशिळा । পঞ্চম পরিচ্ছেদ একদিন মধ্যাহ্নকালে ভবনাথবাবুর গৃহে গিয়া দেখি, তিনি গ্ৰীষ্মের উত্তাপে চৌকিতে ঠেসান দিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন এবং সম্মুখে গঙ্গাতীরের বারান্দায় নির্জন ঘাটের সোপানে বসিয়া কিরণ কী বই পড়িতেছে। আমি নিঃশব্দপদে পশ্চাতে গিয়া দেখি, একখানি নূতন কাব্যসংগ্ৰহ, যে পাতাটি খোলা আছে তাহাতে শেলির একটি কবিতা উদধূত এবং তাহার পাৰ্থে লাল কালিতে একটি পরিষ্কার লাইন টানা । সেই কবিতাটি পাঠ করিয়া কিরণ ঈষৎ একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া স্বল্পভারাকুল নয়নে আকাশে দূরতম প্রান্তের দিকে চাহিল ; বোধ হইল, যেন সেই একটি কবিতা কিরণ আজ এক ঘণ্টা ধরিয়া দশবার করিয়া পড়িয়াছে এবং অনন্ত নীলাকাশে, আপনি হৃদয়তরণীর পালে একটিমাত্র উত্তপ্ত দীর্ঘনিশ্বাস দিয়া, তাহাকে অতিদূর নক্ষত্ৰলোকে প্রেরণা করিয়াছে। শেলি কাহার জন্য এই কবিতাটি লিখিয়াছিল জানি না ; মহীন্দ্রনাথ নামক কোনো বাঙালি যুবকের জন্য লেখে নাই তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু আজ এই স্তবগানে আমি ছাড়া আর-কাহারও অধিকার নাই। ইহা আমি জোর করিয়া বলিতে পারি। কিরণ এই কবিতাটির পাশে আপনি অন্তরতম হৃদয়-পেলিল দিয়া একটি উজ্জ্বল রক্তচিহ্ন আঁকিয়া দিয়াছে, সেই মায়াগণ্ডির মোহমত্রে কবিতাটি আজ তাহারই, এবং সেইসঙ্গে আমারও । আমি পুলকোচ্ছসিত চিত্তকে সংবরণ করিয়া সহজ সুরে কহিলাম, “কী পড়িতেছেন।” পালভরা নীেকা যেন হঠাৎ চড়ায় ঠেকিয়া গেল। কিরণ চমকিয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি বইখানা বন্ধ করিয়া একেবারে আঁচলের মধ্যে ঢাকিয়া ফেলিল । আমি হাসিয়া কহিলাম, “বইখানি একবার দেখিতে পারি ?” কিরণকে কী যেন