পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

OBO ब्रीक-अफ़नावी ইস্কুলমাস্টার কহিলেন আমি এই গ্রামে আসার প্রায় দশ বৎসর পূর্বে এই বাড়িতে ফণিভূষণ সাহা বাস করিতেন। তিনি তাহার অপুত্ৰক পিতৃব্য দুর্গামোহন সাহার বৃহৎ বিষয় এবং ব্যবসায়ের উত্তরাধিকারী হইয়াছিলেন। কিন্তু, তাহাকে একালে ধরিয়াছিল। তিনি লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন। তিনি জুতাসমেত সাহেবের আপিসে ঢুকিয়া সম্পূর্ণ খাটি ইংরাজি বলিতেন। তাহাতে আবার দাড়ি রাখিয়ছিলেন, সুতরাং সাহেব-সওদাগরের নিকট তাহার উন্নতির সম্ভাবনামাত্র ছিল না । তাহাকে দেখিবামাত্রই নব্যবঙ্গ বলিয়া ঠাহির হইত। আবার ঘরের মধ্যেও এক উপসর্গ জুটিয়াছিল। তাহার শ্ৰীটি ছিলেন সুন্দরী । একে কলেজে-পড়া তাহাতে সুন্দরী শ্ৰী, সুতরাং সেকালের চালচলন আর রহিল না। এমন-কি, ব্যামো হইলে অ্যাসিস্টান্ট-সার্জনকে ডাকা হইত। অশন বসন ভূষণও এই পরিমাণে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল । মহাশয় নিশ্চয়ই বিবাহিত, অতএব এ কথা আপনাকে বলাই বাহুল্য যে, সাধারণত স্ত্ৰীজাতি কাচা আম, কাল লিঙ্কা এবং কড়া স্বামীই ভালোবাসে। যে দুৰ্ভাগ্য পুরুষ নিজের স্ত্রীর ভালোবাসা হইতে বঙ্কিত সে-যে কুগ্ৰী অথবা নির্ধন তাহা নহে, সে নিতান্ত নিরীহ । যদি জিজ্ঞাসা করেন, কেন এমন হইল আমি এ সম্বন্ধে অনেক কথা ভাবিয়া রাখিয়াছি । যাহার যা প্ৰবৃত্তি এবং ক্ষমতা সেটার চর্চা না করিলে সে সুখী হয় না। শিঙে শান দিবার জন্য হরিণ শক্ত গাছের গুড়ি খোজে, কলাগাছে তাহার শিং ঘষিবার সুখ হয় না। নরনারীর ভেদ হইয়া অবধি স্ত্রীলোক দুরন্ত পুরুষকে নানা কৌশলে ভুলইয়া বশ করিবার বিদ্যা চর্চা করিয়া আসিতেছে। যে স্বামী আপনি বশ হইয়া বসিয়া থাকে তাহার স্ত্রী-বেচারা একেবারেই বেকার, সে তাহার মাতামহীদের নিকট হইতে শীতলক্ষ বৎসরের শান-দেওয়া যে উজ্জ্বল বরুণাস্ত্ৰ, অগ্নিবাণ ও নাগপাশবন্ধনগুলি পাইয়াছিল তাহা সমস্ত নিৰ্ম্মফল হইয়া যায় । স্ত্রীলোক পুরুষকে ভুলইয়া নিজের শক্তিতে ভালোবাসা আদায় করিয়া লইতে চায়, স্বামী যদি ভালোমানুষ হইয়া সে অবসরটুকু না দেয়, তবে স্বামীর অদৃষ্ট মন্দ এবং স্ত্রীরও ততোধিক । নবসভ্যতার শিক্ষামন্ত্র পুরুষ আপন স্বভাবসিদ্ধ বিধাতাদত্ত সুমহৎ বর্বরতা হারাইয়া আধুনিক দাম্পত্যসম্বন্ধটাকে এমন শিথিল করিয়া ফেলিয়াছে। অভাগা ফণিভূষণ আধুনিক সভ্যতার কাল হইতে অত্যন্ত ভালোমানুষটি হইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছিল- ব্যবসায়েও সে সুবিধা করিতে পারিল না, দাম্পত্যেও তাহার তেমন সুযোগ ঘটে নাই । ফণিভূষণের স্ত্রী মণিমালিকা, বিনা চেষ্টায় আদর, বিনা অশ্রুবর্ষণে ঢাকাই শাড়ি এবং বিনা দুৰ্জয় মানে বাজুবন্ধ লাভ করিত । এইরূপে তাহার নারীপ্ৰকৃতি এবং সেইসঙ্গে তাহার ভালোবাসা নিশ্চেষ্ট হইয়া গিয়াছিল ; সে কেবল গ্রহণ করিত, কিছু দিত না । তাহার নিরীহ এবং নির্বোিধ স্বামীটি মনে করিত, দানই বুঝি প্রতিদান পাইবার উপায় । একেবারে উলটা বুঝিয়াছিল আর কি । ইহার ফল হইল। এই যে, স্বামীকে সে আপনি ঢাকাই শাড়ি এবং বাজুবন্ধ জোগাইবার যন্ত্রস্বরূপ জ্ঞান করিত ; যন্ত্রটিও এমন সুচারু যে, কোনোদিন তাহার চাকায় এক ফোটা তেল জোগাইবারও দরকার ଅସ୍ ଜrଅ । ফণিভূষণের জন্মস্থান ফুলবেড়ে, বাণিজ্যস্থান। এখানে । কর্মানুরোধে এখানেই তাহাকে অধিকাংশ সময় থাকিতে হইত। ফুলবেড়ের বাড়িতে তাহার মা ছিল না, তবু পিসি মাসি ও অন্য পাঁচজন ছিল । কিন্তু, ফণিভূষণ পিসি মাসি ও অন্য পাঁচজনের উপকারার্থেই বিশেষ করিয়া সুন্দরী স্ত্রী ঘরে আনে নাই। সুতরাং স্ত্রীকে সে পাঁচজনের কাছ থেকে আনিয়া এই কুঠিতে একলা নিজের কাছেই রাখিল । কিন্তু অন্যান্য অধিকার হইতে স্ত্রী-অধিকারের প্রভেদ এই যে, স্ত্রীকে পাচজনের কাছ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া একলা নিজের কাছে রাখিলেই যে সব সময় বেশি করিয়া পাওয়া যায় তাহা নহে । স্ত্রীটি বেশি কথাবার্তা কহিত না, পাড়াপ্রতিবেশিনীদের সঙ্গেও তাহার মেলামেশা বেশি ছিল না।