পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ve98 Sq রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অনেক নিগৃঢ় তত্ত্ব মনের মধ্যে উদয় হয়- এগুলো ছাত্রদের কাছে বলিবার বিষয় নয়, কথাপ্রসঙ্গে আপনাকে বলিয়া লইলাম, চিন্তা কারিয়া দেখিবেন । মোটকথাটা এই যে, যদিচ রন্ধনে নুন কম হইত না এবং পানে চুন বেশি হইত না, তথাপি ফণিভূষণের হৃদয় কী-যৌন-কী নামক একটা দুঃসাধ্য উৎপাত অনুভব করিত। মীর কোনো দোষ ছিল না, কোনো ভ্ৰম ছিল না, তবু স্বামীর কোনো সুখ ছিল না । সে তাহার সহধর্মিণীর শূন্যগহবর হৃদয় লক্ষ্য করিয়া কেবলই হীরামুক্তার গহনা ঢালিত কিন্তু সেগুলা পড়িত গিয়া লোহার সিন্দুকে, হৃদয় শূন্যই থাকিত । খুড়া দুৰ্গামোহন ভালোবাসা এত সূক্ষ্ম করিয়া বুঝিত না। এত কাতর হইয়া চাহিত না, এত প্রচুর পরিমাণে দিত না, অথচ খুড়ির নিকট হইতে তাহা অজস্র পরিমাণে লাভ করিত। ব্যবসায়ী হইতে গেলে নব্যবাবু হইলে চলে না এবং স্বামী হইতে গেলে পুরুষ হওয়া দরকার, এ কথায় সন্দেহমাত্র করবেন না । ঠিক এই সময়ে শৃগালগুলা নিকটবতী ঝোপের মধ্য হইতে অত্যন্ত উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল । মাস্টােরমহাশয়ের গল্পস্রোতে মিনিটকয়েকের জন্য বাধা পড়িল । ঠিক মনে হইল, সেই অন্ধকার সভাতৃভূমিতে কৌতুকপ্ৰিয় শৃগালসম্প্রদায় ইস্কুলমাস্টারের ব্যাখ্যাত দাম্পত্যনীতি শুনিয়াই হউক বা নবসভ্যতাদুর্বল ফণিভূষণের আচরণেই হউক রহিয়া রহিয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিতে লাগিল । তাহদের ভাবোচ্ছাস নিবৃত্ত হইয়া জলস্থল দ্বিগুণতর নিস্তািন্ধ হইলে পর, মাস্টার সন্ধ্যার অন্ধকারে র্তাহার বৃহৎ উজ্জ্বল চক্ষু পকাইয়া গল্প বলিতে লাগিলেন ফণিভূষণের জটিল এবং বহুবিস্তৃত ব্যবসায়ে হঠাৎ একটা ফাড়া উপস্থিত হইল । ব্যাপারটা কী তাহা আমার মতো অব্যাবসায়ীর পক্ষে বোঝা এবং বোঝানো শক্ত । মোদা কথা, সহসা কী কারণে বাজারে তাহার ক্রেডিট রাখা কঠিন হইয়া পডিয়াছিল। যদি কেবলমাত্ৰ পাচটা দিনের জন্যও সে কোথাও হইতে লািখদেড়েক টাকা বাহির করিতে পারে, বাজারে একবার বিদ্যুতের মতো এই টাকাটার চেহারা দেখাইয়া যায়, তাহা হইলেই মুহুর্তের মধ্যে সংকট উত্তীর্ণ হইয়া তাহার ব্যাবসা পালভারে চুটিয়া চলিতে পারে । টাকাটার সুযোগ হইতেছিল না। স্থানীয় পরিচিত মহাজনদের নিকট হইতে ধার করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে এরূপ জনরব উঠিলে তাহার ব্যবসায়ের দ্বিগুণ অনিষ্ট হইবে, আশঙ্কায় তাহাকে অপরিচিত স্থানে ঋণের চেষ্টা দেখিতে হইতেছিল । সেখানে উপযুক্ত বন্ধক না। রাখিলে চলে না । গহনা বন্ধক রাখিলে লেখাপড়া এবং বিলম্বের কারণ থাকে না, চটপট এবং সহজেই কাজ হইয়া या । ফণিভূষণ একবার স্ত্রীর কাছে গেল। নিজের স্ত্রীর কাছে স্বামী যেমন সহজভাবে যাইতে পারে ফণিভূষণের তেমন করিয়া যাইবার ক্ষমতা ছিল না । সে দুর্ভাগ্যক্রমে নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসিত, যেমন ভালোবাসা কাব্যের নায়ক কাব্যের নায়িকাকে বাসে ; যে ভালোবাসায় সম্ভপাণে পদক্ষেপ করিতে হয় এবং সকল কথা মুখে ফুটিয়া বাহির হইতে পারে না, যে ভালোবাসার প্রবল আকর্ষণ সূর্য এবং পৃথিবীর আকর্ষণের ন্যায় মাঝখানে একটা অতিদূর ব্যবধান রাখিয়া দেয় । তথাপি তেমন তেমন দায়ে পড়িলে কাব্যের নায়ককেও প্ৰেয়সীর নিকট হুণ্ডি এবং বন্ধক এবং হ্যান্ডনেটের প্রসঙ্গ তুলিতে হয় ; কিন্তু সুর বাধিয়া যায়, বাক্যাম্বলন হয়, এমন সকল পরিষ্কার কাজের কথার মধ্যেও ভাবের জড়িমা ও বেদনার বেপথু আসিয়া উপস্থিত হয়। হতভাগ্য ফণিভূষণ স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারিল না, ‘ওগো, আমার দরকার হইয়াছে, তোমার গহনাগুলো দাও ।' কথাটা বলিল, অথচ অত্যন্ত দুর্বলভাবে বলিল। মণিমালিকা যখন কঠিন মুখ করিয়া হা-না কিছুই, উত্তর করিল না, তখন সে একটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর আঘাত পাইল কিন্তু আঘাত করিল না। কারণ, পুরুষোচিত বর্বরতা লেশমাত্র তাহার ছিল না। যেখানে জোর করিয়া কাড়িয়া লওয়া উচিত ছিল,