পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

邻丽岛硬 O86 চাই তো।” এই বলিয়া মণিমালিকার পিত্ৰালয়ে লোক পঠাইয়া দিল। সেখান হইতে খবর আসিল, মণি অথবা মধু এ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছে নাই । তখন চারি দিকে খোজ পড়িয়া গেল। নদীতীরে-তীরে প্রশ্ন করিতে করিতে লোক ছুটিল । মধুর তল্লাস করিতে পুলিসে খবর দেওয়া হইল— কোন নৌকা, নীেকার মাঝি কে, কোন পথে তাহারা কোথায় চলিয়া গেল, তাহার কোনো সন্ধান মিলিল না । সর্বপ্রকার আশা ছাড়িয়া দিয়া একদিন ফণিভূষণ সন্ধ্যাকালে তাহার পরিত্যক্ত শয়নগহের মধ্যে প্ৰবেশ করিল। সেদিন জন্মাষ্টমী, সকাল হইতে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়িতেছে। উৎসব উপলক্ষে গ্রামের প্ৰান্তরে একটা মেলা বসে, সেখানে আটচালার মধ্যে বারোয়ারির যাত্রা আরম্ভ হইয়াছে। মুষলধারায় বৃষ্টিপাতশব্দে যাত্রার গানের সুর মৃদুতর হইয়া কানে আসিয়া প্রবেশ করিতেছে। ঐ-যে বাতায়নের উপরে শিথিলকজা দরজাটা বুলিয়া পডিয়াছে ঐখানে ফণিভূষণ অন্ধকারে একলা বসিয়াছিল— বাদলার হাওয়া বৃষ্টির ছাট এবং যাত্রার গান ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতেছিল, কোনো খেয়ালই ছিল না । ঘরের দেওয়ালে আর্ট স্টািডয়ো-রচিত লক্ষ্মীসরস্বতীর এক জোড়া ছবি টাঙানো ; আলনার উপরে একটি গামছা ও তোয়ালে, একটি চুড়িপেড়ে ও একটি ডুরে শাড়ি সদাব্যবহারযোগ্যভাবে পাকানো ঝুলানো রহিয়াছে। ঘরের কোণে টিপাইয়ের উপরে পিতলের ডিবায় মণিমালিকার স্বহস্তেরচিত গুটিকতক পান। শুষ্ক হইয়া পড়িয়া আছে। কাচের আলমারির মধ্যে তাহার আবালাসঞ্চিত চীনের পুতুল, এসেন্সের শিশি, রঙিন কাচের ডিক্যান্টার, শৌখিন তাস, সমুদ্রের বড়ো বড়ো কড়ি, এমন-কি, শুনা সাবানের বাক্সগুলি পর্যন্ত অতি পরিপাটি করিয়া সাজানো ; যে অতিক্ষুদ্র গোলকবিশিষ্ট ছোটাে শখের কেরোসিন-ল্যাম্প সে নিজে প্রতিদিন প্রস্তুত করিয়া স্বহস্তে জ্বালাইয়া কুলুঙ্গিটির উপর রাখিয়া দিত তাহা যথাস্থানে নির্বাপিত এবং স্নান হইয়া দাড়াইয়া আছে, কেবল সেই ক্ষুদ্র ল্যাম্পটি এই শয়নকক্ষে মণিমালিকার শেষ মূহুর্তের নিরুত্তর সাক্ষী ; সমস্ত শূন্য করিয়া যে চলিয়া যায়, সেও এত চিহ্ন, এত ইতিহাস, সমস্ত জডসামগ্ৰীীর উপর আপনি সজীব হৃদয়ের এত মোহস্বাক্ষর রাখিয়া যায় ! এসো মণিমালিকা, এসো, তোমার দীপটি তুমি জ্বালাও, তোমার ঘরটি তুমি আলো করো, আয়নার সম্মুখে দাড়াইয়া তোমার যত্নকুঞ্চিত শাড়িটি তুমি পরো, তোমার জিনিসগুলি তোমার জন্য অপেক্ষা করিতেছে । তোমার কাছ হইতে কেহ কিছু প্ৰত্যাশা করে না, কেবল তুমি উপস্থিত হইয়া মাত্র তোমার অক্ষয় যৌবন তোমার অস্নান সৌন্দর্য লইয়া চারি দিকের এই সকল বিপুল বিক্ষিপ্ত অনাথ জড়সামগ্ৰী৷রাশিকে একটি প্রাণের ঐক্যে সঞ্জীবিত করিয়া রাখে ; এই-সকল মূক প্রাণহীন পদার্থের অব্যক্ত ক্ৰন্দন গৃহকে শ্মশান করিয়া তুলিয়াছে। গভীর রাত্রে কখন একসময়ে বৃষ্টির ধারা এবং যাত্রার গান থামিয়া গেছে। ফণিভূষণ জানলার কাছে যেমন বসিয়াছিল তেমনি বসিয়া আছে। বাতায়নের বাহিরে এমন একটা জগদব্যাপী নীরন্ধ অন্ধকার যে তাহার মনে হইতেছিল, যেন সম্মুখে যমালয়ের একটা অভ্ৰভেদী সিংহদ্বার, যেন এইখানে দাড়াইয়া কাদিয়া ডাকিলে চিরকালের লুপ্ত জিনিস অচিরকালের মতো একবার দেখা দিতেও পারে। এই মসীকৃষ্ণ মৃত্যুর পটে, এই অতি কঠিন নিকষ-পাষণের উপর এই হারানো সোনার একটি রেখা পড়িতেও পারে । এমন সময় একটা ঠকঠক শব্দের সঙ্গে সঙ্গে গহনার ঝমােঝম শব্দ শোনা গেল। ঠিক মনে হইল, শব্দটা নদীর ঘাটের উপর হইতে উঠিয়া আসিতেছে । তখন নদীর জল এবং রাত্রির অন্ধকার এক হইয়া মিশিয়া গিয়াছিল । পুলকিত ফণিভূষণ দুই উৎসুক চক্ষু দিয়া অন্ধকার ঠেলিয়া ঠেলিয়া ফুড়িয়া ফুড়িয়া দেখিতে চেষ্টা করিত্বে লাগিল- স্ফীত হৃদয় এবং ব্যগ্ৰ দৃষ্টি ব্যথিত হইয়া উঠিল, কিছুই দেখা গোল না। দেখিবার চেষ্টা যতই একান্ত বাড়িয়া উঠিল। অন্ধকার ততই যেন ঘনীভূত, জগৎ ততই যেন ছায়াবৎ হইয়া আসিল । প্রকৃতি নিশীথরাত্রে আপনি মৃত্যুনিকেতনের গবাক্ষস্থারে অকস্মাৎ অতিথিসমাগম দেখিয়া দ্রুত হন্তে আরো একটা বেশি করিয়া পর্দা ফেলিয়া দিল । শব্দটা ক্রমে ঘাটের সর্বোচ্চ সোপানতল ছাড়িয়া বাড়ির দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল । বাডির