পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

few W w98ዓ ফণিভূষণ নিজের ললাটে সবলে আঘাত করিল। VA পরদিন মেলা ভাঙিয়া গেছে। দোকানি এবং যাত্রার দল চলিয়া গেল। ফণিভূষণ হুকুম দিল, সেইদিন সন্ধ্যার পর তাহার বাড়িতে সে নিজে ছাড়া আর কেহই থাকিবে না । চাকরেরা স্থির করিল, বাবু তাত্রিকমতে একটা কী সাধনে নিযুক্ত আছেন । ফণিভূষণ সমস্তদিন উপবাস করিয়া রহিল। জনশূন্য বাড়িতে সন্ধ্যাবেলায় ফণিভূষণ বাতায়নতলে আসিয়া বসিল । সেদিন আকাশের স্থানে স্থানে মেঘ ছিল না, এবং ধৌত নির্মল বাতাসের মধ্য দিয়া নক্ষত্রগুলিকে অত্যুজ্জল দেখাইতেছিল। কৃষ্ণপক্ষ দশমীর চাদ উঠিতে অনেক বিলম্ব আছে। মেলা উত্তীর্ণ হইয়া যাওয়াতে পরিপূর্ণ নদীতে নৌকা মাত্রই ছিল না এবং উৎসবজাগরণক্লান্ত গ্রাম দুইরাত্রি জাগরণের পর আজ গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন । ফণিভূষণ একখানা চৌকিতে বসিয়া চৌকির পিঠের উপর মাথা উর্ধর্বমুখ করিয়া তারা দেখিতেছিল ; ভাবিতেছিল, একদিন যখন তাহার বয়স ছিল। উনিশ, যখন কলিকাতার কলেজে পড়িত, যখন সন্ধ্যাকালে গোলদিঘির তৃণশয়নে চিত হইয়া, হাতের উপরে মাথা রাখিয়া, ঐ অনন্তকালের তারাগুলির দিকে চাহিয়া থাকিত এবং মনে পড়িত তাহার সেই নদীকৃলবতী শ্বশুরবাড়ির একটি বিরলকক্ষে চোদবৎসরের বয়ঃসন্ধিগত মণির সেই উজ্জ্বল কাচা মুখখানি, তখনকার সেই বিরহ কী সুমধুর, তখনকার সেই তারাগুলির আলোকম্পন্দন হৃদয়ের যৌবনম্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে কী বিচিত্র ‘বসন্তরাগেণ যতিতালাভ্যাং’ বাজিয়া বাজিয়া উঠিত ! আজি সেই একই তারা আগুন দিয়া আকাশে মোহমুদগরের শ্লোক কয়টা লিখিয়া রাখিয়াছে ; বলিতেছে, সংসারোহঁয়মতীব বিচিত্ৰঃ !. দেখিতে দেখিতে তারাগুলি সমস্ত লুপ্ত হইয়া গেল। আকাশ হইতে একখানা অন্ধকার নামিয়া এবং পৃথিবী হইতে একখানা অন্ধকার উঠিয়া চোখের উপরকার এবং নীচেকার পল্লবের মতো একত্র আসিয়া মিলিত হইল। আজ ফণিভূষণের চিত্ত শান্ত ছিল । সে নিশ্চয় জানিত, আজ তাহার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে, সাধকের নিকট মৃতু্য আপন রহস্য উদঘাটন করিয়া দিবে। পূর্বরাত্রির মতো সেই শব্দ নদীর জলের মধ্য হইতে ঘাটের সোপানের উপর উঠিল। ফণিভূষণ দুই চক্ষু নিমীলিত করিয়া স্থির দৃঢ়চিত্তে ধ্যানাসনে বসিল । শব্দ দ্বারীশূন্য দেউড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল, শব্দ জনশূন্য অন্তঃপুরের গোলসিঁড়ির মধ্য দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া উঠিতে লাগিল, শব্দ দীর্ঘ বারান্দা পার হইল এবং শয়নকক্ষের দ্বারের কাছে আসিয়া ক্ষণকালের জন্য থামিল । ফণিভূষণের হৃদয় ব্যাকুল এবং সর্বাঙ্গ কণ্টকিত হইয়া উঠিল, কিন্তু আজ সে চক্ষু খুলিল না । শব্দ চৌকাঠ পার হইয়া অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। আলনায় যেখানে শাড়ি কোচানো আছে, কুলুঙ্গিতে যেখানে কেরোসিনের দীপ দাড়াইয়া, টিপাইয়ের ধারে যেখানে পানের বঁাটায় পান। শুষ্ক, এবং সেই বিচিত্রসামগ্ৰীপূৰ্ণ আলমারির কাছে প্রত্যেক জায়গায় এক-একবার করিয়া দাড়াইয়া অবশেষে শব্দটা ফণিভূষণের অত্যন্ত কাছে আসিয়া থামিল । তখন ফণিভূষণ চোখ মেলিল এবং দেখিল, ঘরে নবেদিত দশমীর চন্দ্রালোক আসিয়া প্ৰবেশ করিয়াছে, এবং তাহার চৌকির ঠিক সম্মুখে একটি কঙ্কাল দাড়াইয়া । সেই কুঙ্কালের আট আঙুলে আংটি, করতলে রতনচক্ৰ, প্রকোষ্ঠে বালা, বাহুতে বাজুবন্ধ, গলায় কঠি, মাথায় সিঁথি, তাহার আপাদমস্তকে অস্থিতে অস্থিতে এক-একটি আভরণ সোনায় হীরায় ঝকঝকি করিতেছে । অলংকারগুলি ঢ়িলা, ঢলঢল করিতেছে, কিন্তু অঙ্গ হইতে খসিয়া পড়িতেছে না। সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর, তাহার অস্থিময় মুখে তাহার দুই চক্ষু ছিল সজীব ; সেই কালো তারা, সেই ঘনদীর্ঘ পল্প, সেই সজল উজ্জ্বলতা, সেই অবিচলিত দৃঢ়শান্তি দৃষ্টি । আজি আঠারো বৎসর পূর্বে একদিন আলোকিত সভাগৃহে নহবতের সাহানা আলাপের মধ্যে ফণিভূষণ যে দুটি আয়ত-সুন্দর কালো-কালো ঢলঢল চোখ শুভদৃষ্টিতে প্রথম দেখিয়াছিল সেই দুটি চক্ষুই আজ শ্রাবণের অর্ধরাত্রে কৃষ্ণপক্ষ দশমীর চন্দ্ৰকিরণে দেখিল ; দেখিয়া তাহার সর্বশরীরে রক্ত হিম হইয়া আসিল । প্ৰাণপণে দুই চক্ষু বুজিতে চেষ্টা করিল, কিছুতেই পারিল না ; তাহার চক্ষু মৃত্ত মানুষের চক্ষুর মতো নির্নিমেষ চাহিয়া রহিল । তখন সেই কঙ্কাল স্তম্ভিত ফণিভূষণের মুখের দিকে তাহার দৃষ্টি স্থির রাখিয়া দক্ষিণ হন্ত তুলিয়া