পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOG SR রবীন্দ্র-রচনাবলী যে কাজ নিজে করিতে পারিতাম না সে আমি তাহাকে দিয়া করাইতাম ।" স্বামী কহিলেন, “কাজ তো দাসীতেও করে । আমি কি কাজের সুবিধার জন্য একটা দাসী বিবাহ করিয়া আমার এই দেবীর সঙ্গে একাসনে বসাইতে পারি।” বলিয়া আমার মুখ তুলিয়া ধরিয়া আমার ললাটে একটি নির্মল চুম্বন করিলেন ; সেই চুম্বনের দ্বারা আমার যেন তৃতীয় নেত্র উল্মীলিত হইল, সেইক্ষণে আমার দেবীত্বে অভিষেক হইয়া গেল। আমি মনে মনে কহিলাম, সেই ভালো । যখন অন্ধ হইয়াছি তখন আমি এই বহিঃসংসারের আর গৃহিণী হইতে পারি না, এখন আমি সংসারের উপরে উঠিয়া দেবী হইয়া স্বামীর মঙ্গল করিব। আর মিথ্যা নয়, ছলনা নয়, গৃহিণী রমণীর যতকিছু ক্ষুদ্রতা এবং কপটতা আছে সমস্ত দূর করিয়া দিলাম । সেদিন সমস্ত দিন নিজের সঙ্গে একটা বিরোধ চলিতে লাগিল । গুরুতর শপথে বাধা হইয়া স্বামী যে কোনোমতেই দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে পরিবেন না, এই আনন্দ মনের মধ্যে যেন একেবারে দংশন করিয়া রহিল ; কিছুতেই তাহাকে ছাড়াইতে পারিলাম না । অদ্য আমার মধ্যে যে নুতন দেবীর আবির্ভাব হইয়াছে তিনি কহিলেন, “হয়তো এমন দিন আসিতে পারে যখন এই শপথ-পালন অপেক্ষা বিবাহ করিলে তোমার স্বামীর মঙ্গল হইবে ।" কিন্তু আমার মধ্যে যে পুরাতন নারী ছিল সে কহিল, ‘তা হউক, কিন্তু তিনি যখন শপথ করিয়াছেন তখন তো আর বিবাহ করিতে পরিবেন না ।” দেবী কহিলেন, ‘তা হউক, কিন্তু ইহাতে তোমার খুশি হইবার কোনো কারণ নাই ।” মানবী কহিল, “সকলই বুঝি, কিন্তু যখন তিনি শপথ করিয়াছেন তখন ইত্যাদি । বার বার সেই এক কথা । দেবী তখন কেবল নিরুত্তরে ভুকুটি করিলেন এবং একুটা ভয়ংকর আশঙ্কার অন্ধকারে আমার সমস্ত অন্তঃকরণ আচ্ছন্ন হইয়া গেল । আমার অনুতপ্ত স্বামী চাকরিদাসীকে নিষেধ করিয়া নিজে আমার সকল কাজ করিয়া দিতে উদ্যত হইলেন । স্বামীর উপর তুচ্ছ বিষয়েও এইরূপ নিরুপায় নির্ভর প্রথমটা ভালোই লাগিত । কারণ, এমনি করিয়া সর্বদাই তাহাকে কাছে পাইতাম । চোখে তাহাকে দেখিতাম না বলিয়া তাহাকে সর্বদা কাছে পাইবার আকাঙক্ষা অত্যন্ত বাডিয়া উঠিল । স্বামীসুখের যে অংশ আমার চোখের ভাগে পড়িয়াছিল সেইটে এখন অন্য ইন্দ্ৰিয়েরা বাটিয়া লইয়া নিজেদের ভাগ বাড়াইয়া লইবার চেষ্টা করিল। এখন আমার স্বামী অধিকক্ষণ বাহিরের কাজে থাকিলে মনে হইত, আমি যেন শূন্যে রহিয়াছি, আমি যেন কোথাও কিছু ধরিতে পারিতেছি না, আমার যেন সব হারাইল । পূর্বে স্বামী যখন কলেজে যাইতেন তখন বিলম্ব হইলে পথের দিকের জানালা একটুখানি ফাক করিয়া পথ চাহিয়া থাকিতাম । যে জগতে তিনি বেড়াইতেন সে জগৎটাকে আমি চোখের দ্বারা নিজের সঙ্গে বাধিয়া রাখিয়াছিলাম । আজ আমার দৃষ্টিহীন সমস্ত শরীর তীহাকে অন্বেষণ করিতে চেষ্টা করে । তাহার পৃথিবীর সহিত আমার পৃথিবীর যে প্রধান সাকো ছিল সেটা আজ ভাঙিয়া গেছে । এখন তাহার এবং আমার মাঝখানে একটা দুস্তর অন্ধতা ; এখন আমাকে কেবল নিরুপায় ব্যগ্রভাবে বসিয়া থাকিতে হয়, কখন তিনি তাহার পার হইতে আমার পারে আপনি আসিয়া উপস্থিত হইবেন । সেইজন্য এখন, যখন ক্ষণকালের জন্যও তিনি আমাকে ছাড়িয়া চলিয়া যান। তখন আমার সমস্ত অন্ধ দেহ উদ্যত হইয়া তাহাকে ধরিতে যায়, হাহাকার করিয়া তাহাকে ডাকে । কিন্তু এত আকাঙক্ষা, এত নির্ভর তো ভালো নয় । একে তো স্বামীর উপরে স্ত্রীর ভারই যথেষ্ট, তাহার উপরে আবার অন্ধতার প্রকাণ্ড ভার চাপাইতে পারি না । আমার এই বিশ্বজোড়া অন্ধকার, এ আমিই বহন করিব । আমি একাগ্রামনে প্ৰতিজ্ঞা করিলাম, আমার এই অনন্ত অন্ধতা দ্বারা স্বামীকে আমি আমার সঙ্গে বাধিয়া রাখিব না । অল্পকালের মধ্যেই কেবল শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের দ্বারা আমি আমার সমন্ত অভ্যন্ত কর্ম সম্পন্ন করিতে শিখিলাম। এমন-কি, আমার অনেক গৃহকর্ম পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি নৈপুণ্যের সহিত নির্বাহ করিতে পারিলাম। এখন মনে হইতে লাগিল, দৃষ্টি আমাদের কাজের যতটা সাহায্য করে তাহার চেয়ে ঢের বেশি বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয় । যতটুকু দেখিলে কাজ ভালো হয় চোখ তাহার চেয়ে ঢের বেশি দেখে । এবং চোখ যখন পাহারার কাজ করে কান তখন অলস হইয়া যায়, যতটা তাহার শোনা উচিত তাহার