পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓisiqፅቛ WGO চেয়ে সে কম শোনে । এখন চঞ্চল চোখের অবর্তমানে আমার অন্য সমস্ত ইন্দ্ৰিয় তাহদের কর্তব্য শান্ত এবং সম্পূর্ণভাবে করিতে লাগিল । এখন আমার স্বামীকে আর আমার কোনো কাজ করিতে দিলাম না, এবং তাহার সমস্ত কাজ আবার পূর্বের মতো আমিই করিতে লাগিলাম । স্বামী আমাকে কহিলেন, “আমার প্রায়শ্চিত্ত হইতে আমাকে বঞ্চিত করিতেছি ।” আমি কহিলাম, “তোমার প্রায়শ্চিত্ত কিসের আমি জানি না, কিন্তু আমার পাপের ভার আমি বাড়াইব কেন ।” যাহাঁই বলুন, আমি যখন তাহাকে মুক্তি দিলাম তখন তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া বঁচিলেন ; অন্ধ স্ত্রীর সেবাকে চিরজীবনের ব্রত করা পুরুষের কর্ম নহে । আমার স্বামী ডাক্তারি পাস করিয়া আমাকে সঙ্গে লইয়া মফস্বলে গেলেন । পাড়াগায়ে আসিয়া যেন মাতৃক্ৰোড়ে আসিলাম মনে হইল। আমার আট বৎসর বয়সের সময় আমি গ্রাম ছাডিয়া শহরে আসিয়াছিলাম । ইতিমধ্যে দশ বৎসরে জন্মভূমি আমার মনের মধ্যে ছায়ার মতো অস্পষ্ট হইয়া আসিয়াছিল । যতদিন চক্ষু ছিল কলিকাতা শহর আমার চারি দিকে আর-সমস্ত স্মৃতিকে আড়াল করিয়া দাড়াইয়াছিল । চােখ যাইতেই বুঝিলাম, কলিকাতা কেবল চােখ ভুলইয়া রাখিবার শহর, ইহাতে মন ভরিয়া রাখে না | দৃষ্টি হারাইবামাত্র আমার সেই বাল্যকালের পল্লীগ্রাম দিব্যাবসানে নক্ষত্ৰলোকের মতো আমার মনের মধ্যে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল । অগ্রহায়ণের শেষাশেষি আমরা হাসিমপুরে গেলাম । নূতন দেশ, চারি দিক দেখিতে কিরকম তাহা বুঝিলাম না, কিন্তু বাল্যকালের সেই গন্ধে এবং অনুভাবে আমাকে সর্বাঙ্গে বেষ্টন করিয়া ধরিল । সেই শিশিরে-ভেজা নূতন চাষা থেত হইতে প্ৰভাতের হাওয়া, সেই সোনা-ঢালা অড়ার এবং সরিষা-খেতের আকাশ-ভরা কোমল সুমিষ্ট গন্ধ, সেই রাখালের গান, এমন-কি, ভাঙা রাস্তা দিয়া গোরুর গাড়ি চলার শব্দ পর্যন্ত আমাকে পুলকিত করিয়া তুলিল। আমার সেই জীবনারম্ভের অতীত স্মৃতি তাহার অনির্বাচনীয় ধ্বনি ও গন্ধ লইয়া প্রত্যক্ষ বর্তমানের মতো আমাকে ঘিরিয়া বসিল ; অন্ধ চক্ষু তাহার কোনো প্ৰতিবাদ করিতে পারিল না । সেই বাল্যকালের মধ্যে ফিরিয়া গেলাম, কেবল মাকে পাইলাম না। মনে মনে দেখিতে পাইলাম, দিদিমা তাহার বিরল কেশগুচ্ছ মুক্ত করিয়া রৌদ্রে পিঠ দিয়া প্রাঙ্গণে বড়ি দিতেছেন, কিন্তু তাহার সেই মৃদুকম্পিত প্রাচীন দুর্বল কণ্ঠে আমাদের গ্রাম্য সাধু ভজনদাসের দেহতত্ত্ব-গান গুঞ্জনস্বরে শুনিতে পাইলাম না ; সেই নবারের উৎসব শীতের শিশিরক্সাত আকাশের মধ্যে সজীব হইয়া জাগিয়া উঠিল, কিন্তু টেকিশালে নূতন ধান কুটিবার জনতার মধ্যে আমার ছোটাে ছোটাে পরিসঙ্গিনীদের সমাগম কোথায় গেল ! সন্ধ্যাবেলা অদূরে কোথা হইতে হাম্বাধঘনি শুনিতে পাই, তখন মনে পড়ে, মা সন্ধ্যাদীপ হাতে করিয়া গোয়ালে আলো দেখাইতে যাইতেছেন ; সেইসঙ্গে ভিজা জাবনার ও খড়-জ্বালানো ধোয়ার গন্ধ যেন হৃদয়ের মধ্যে প্ৰবেশ করে এবং শুনিতে পাই, পুকুরের পাড়ে বিদ্যালংকারদের ঠাকুরবাড়ি হইতে কাসরঘণ্টার শব্দ আসিতেছে। কে যেন আমার সেই শিশুকালের আটটি বৎসরের মধ্য হইতে তাহার সমস্ত বস্তু-অংশ ছাকিয়া লইয়া কেবল তাহার রসাটুকু গন্ধাটুকু আমার চারি দিকে রাশীকৃত করিয়াছে। এইসঙ্গে আমার সেই ছেলেবেলাকার ব্ৰত এবং ভোরবেলায় ফুল তুলিয়া শিবপূজার কথা মনে পড়িল । এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে, কলিকাতার আলাপ-আলোচনা আনাগোনার গোলমালে বুদ্ধির একটু বিকার ঘটেই। ধর্মকর্ম-ভক্তিশ্রদ্ধার মধ্যে নির্মল সরলতাটুকু থাকে না । সেদিনের কথা আমার মনে পড়ে যেদিন অন্ধ হওয়ার পরে কলিকাতায় আমার পরিবাসিনী এক সখী আসিয়া আমাকে বলিয়াছিল, “তোর রাগ হয় না, কুমু ? আমি হইলে এমন স্বামীর মুখ দেখিতাম না।” আমি বলিলাম, “ভাই, মুখ দেখা তো বন্ধই বটে, সেজন্যে এ পোড়া চোখের উপর রাগ হয়, কিন্তু স্বামীর উপর রাগ করিতে যাইব কেন।” যথাসময়ে ডাক্তার ডাকেন নাই বলিয়া লাবণ্য আমার স্বামীর উপর অত্যন্ত রাগিয়াছিল এবং আমাকেও রাগাইবার চেষ্টা করিয়াছিল। আমি তাহাকে বুঝাইলাম, সংসারে থাকিলে