পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

оu Vo তাহারা আর-একটা হৃদয়াবেগে আবার উপরে উঠতে পারে, কিন্তু এই-যে দিনে দিনে পলে পলে মজার ভিতর হইতে কঠিন হইয়া যাওয়া, বাহিরে বাড়িয়া উঠিতে উঠিতে অন্তরকে তিলে তিলে চাপিয়া ফেলা, ইহার প্রতিকার ভাবিতে গেলে কোনো রান্তা খুজিয়া পাই না। স্বামীর সঙ্গে আমার চোখে-দেখার যে বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে সে কিছুই নয় ; কিন্তু প্ৰাণের ভিতরটা যেন ইপাইয়া ওঠে যখন মনে করি, আমি যেখানে তিনি সেখানে নাই; আমি অন্ধ, সংসারের আলোকবর্জিত অন্তরপ্রদেশে আমার সেই প্ৰথম বয়সের নবীন প্ৰেম, অক্ষুধা ভক্তি, অখণ্ড বিশ্বাস লইয়া বসিয়া আছি- আমার দেবমন্দিরে জীবনের আরম্ভে আমি বালিকার করপুটে যে শেফালিকার অর্ঘ্যদান করিয়াছিলাম তাহার শিশির এখনো শুকায় নাই ; আর, আমার স্বামী এই ছায়াশীতল চিরনবীনতার দেশ ছাড়িয়া টাকা-উপার্জনের পশ্চাতে সংসারমরুভূমির মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হইয়া চলিয়া যাইতেছেন ! আমি যাহা বিশ্বাস করি, যাহাকে ধর্ম বলি, যাহাকে সকল সুখ-সম্পত্তির অধিক বলিয়া জানি, তিনি অতিদূর হইতে তাহার প্রতি হাসিয়া কটাক্ষপাত করেন ! কিন্তু একদিন এ বিচ্ছেদ ছিল না, প্রথম বয়সে আমরা এক পথেই যাত্রা আরম্ভ করিয়াছিলাম ; তাহার পরে কখন যে পথের ভেদ হইতে আরম্ভ হইতেছিল তাহা তিনিও জানিতে পারেন নাই, আমিও জানিতে পারি নাই ; অবশেষে আজ আমি আর তাহাকে ডাকিয়া সাড়া পাই না । এক-এক সময়ে ভাবি, হয়তো অন্ধ বলিয়া সামান্য কথাকে। আমি বেশি করিয়া দেখি । চক্ষু থাকিলে আমি হয়তো সংসারকে ঠিক সংসারের মতো করিয়া চিনিতে পারিতাম । আমার স্বামীও আমাকে একদিন তাহাঁই বুঝাইয়া বলিলেন । সেদিন সকালে একটি বৃদ্ধ মুসলমান তাহার পৌত্রীর ওলাউঠার চিকিৎসার জন্য তাহাকে ডাকিতে আসিয়াছিল । আমি শুনিতে পাইলাম সে কহিল, “বাবা আমি গরিব, কিন্তু আল্লা তোমার ভালো করিবেন।” আমার স্বামী কহিলেন, “আল্লা যাহা করিবেন কেবল তাহাতেই আমার চলিবে না, তুমি কী করিবে সেটা আগে শুনি ।” শুনিবা মাত্র ভাবিলাম, ঈশ্বর আমাকে অন্ধ করিয়াছেন, কিন্তু বধির করেন নাই কেন । বৃদ্ধ গভীর দীর্ঘনিশ্বাসের সহিত ‘হে আল্লা' বলিয়া বিদায় হইয়া গেল। আমি তখনই বিকে দিয়া তাহাকে অন্তঃপুরের খিড়কিদ্বারে ডাকাইয়া আনিলাম ; কহিলাম, “বাবা, তোমার নাতনির জন্য এই ডাক্তারের খরচা কিছু দিলাম, তুমি আমার স্বামীর মঙ্গল প্রার্থনা করিয়া পাড়া হইতে হরিশ ডাক্তারকে ডাকিয়া লইয়া যাও।” কিন্তু সমস্ত দিন আমার মুখে অন্ন রুচিল না । স্বামী অপরাহুে নিদ্রা হইতে জাগিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাকে বিমর্ষ দেখিতেছি কেন।” পূর্বকালের অভ্যন্ত উত্তর একটা মুখে আসিতেছিল'না, কিছুই হয় নাই ; কিন্তু ছলনার কাল গিয়াছে, আমি স্পষ্ট করিয়া বলিলাম, “কতদিন তোমাকে বলিব মনে করি, কিন্তু বলিতে গিয়া ভাবিয়া পাই না, ঠিক কী বলিবার আছে । আমার অন্তরের কথাটা আমি বুঝাইয়া বলিতে পারিব কি না জানি না, কিন্তু নিশ্চয় তুমি নিজের মনের মধ্যে বুঝিতে পাের, আমরা দুজনে যেমনভাবে এক হইয়া জীবন আরম্ভ করিয়াছিলাম আজ তাহা পৃথক হইয়া গেছে।” স্বামী হাসিয়া কহিলেন, “পরিবর্তনই তো সংসারের ধর্ম।” আমি কহিলাম, “টাকাকড়ি রূপযেীবন সকলেরই পরিবর্তন হয়, কিন্তু নিত্য জিনিস কি কিছুই নাই ।” তখন তিনি একটু গভীর হইয়া কহিলেন, “দেখাে, অন্য শ্ৰীলোকেরা সত্যকার অভাব লইয়া দুঃখ করে- কাহারও স্বামী উপার্জন করে না, কাহারও স্বামী ভালোবাসে না, তুমি আকাশ হইতে দুঃখ টানিয়া আন ।” আমি তখনই বুঝিলাম, অন্ধতা’ আমার চোখে এক অঞ্জন মাখাইয়া আমাকে এই পরিবর্তমান সংসারের বাহিরে লইয়া গেছে, আমি অন্য স্ত্রীলোকের মতো নহি, আমাকে আমার স্বামী বুঝিবেন না । ইতিমধ্যে আমার এক পিসশাশুড়ি দেশ হইতে র্তাহার, ভ্রাতুষ্পপুত্রের সংবাদ লইতে আসিলেন । আমরা উভয়ে তাহাকে প্ৰণাম করিয়া উঠিতেই তিনি প্রথম কথাতেই বলিলেন, “বলি, বউমা, তুমি তো কপালক্রমে দুইটি চক্ষু খোয়াইয়া বসিয়াছ, এখন আমাদের অবিনাশ অন্ধ শ্ৰীকে লইয়া ঘরকন্না চালাইবে কী করিয়া । উহার আর-একটা বিয়ে-থাওয়া দিয়া দাও !” স্বামী যদি ঠাট্টা করিয়া বলিতেন তা বেশ তো পিসিমা, তোমরা দেখিয়া-শুনিয়া একটা ঘটকালি করিয়া দাও-না- তাহা হইলে সমান্ত পরিষ্কার