পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V0(2V9 রবীন্দ্র-রচনাবলী হইয়া যাইত। কিন্তু তিনি কুষ্ঠিত হইয়া কহিলেন, “আঃ, পিসিমা, কী বলিতেছ।” পিসিমা উত্তর করিলেন, “কেন, অন্যায় কী বলিতেছি । আচ্ছা, বউমা, তুমিই বলে তো, বাছা।” আমি হাসিয়া কহিলাম, “পিসিমা, ভালো লোকের কাছে পরামর্শ চাহিতেছ। যাহার গাঠ কাটিতে হইবে তাহার কি কেহ সম্মতি নেয়।” পিসিমা উত্তর করিলেন, “ই, সে কথা ঠিক বটে । তা, তোতে আমাতে গোপনে পরামর্শ করিব, কী বলিস, অবিনাশ । তাও বলি, বউমা, কুলীনের মেয়ের সতিন যত বেশি হয়, তাহার স্বামিগৌরব ততই বাড়ে । আমাদের ছেলে ডাক্তারি না করিয়া যদি বিবাহ করিত, তবে উহার রোজগারের ভাবনা কী ছিল । রোগী তো ডাক্তারের হাতে পড়িলেই মরে, মরিলে তো আর ভিজিট দেয় না, কিন্তু বিধাতার শাপে কুলীনের স্ত্রীর মরণ নাই এবং সে যতদিন বঁাচে ততদিনই স্বামীর লাভ ৷” করিয়া বউয়ের সাহায্য করিতে পারে, এমন একটি ভদ্রঘরের স্ত্রীলোক দেখিয়া দিতে পার ? উনি চোখে দেখিতে পান না, সর্বদা ওঁর একটি সঙ্গিনী কেহ থাকিলে আমি নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি।” যখন নূতন অন্ধ হইয়াছিলাম তখন এ কথা বলিলে খাটিত, কিন্তু এখন চোখের অভাবে আমার কিংবা ঘরকন্নার বিশেষ কী অসুবিধা হয় জানি না ; কিন্তু প্ৰতিবাদমাত্র না করিয়া চুপ করিয়া রহিলাম । পিসিমা কহিলেন, “অভাব কী । আমারই তো ভাসুরের এক মেয়ে আছে, যেমন সুন্দরী তেমনি লক্ষ্মী । মেয়েটির বয়স হইল, কেবল উপযুক্ত বরের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করিয়া আছে ; তোমার মতো কুলীন পাইলে এখনই বিবাহ দিয়া দেয় ।” স্বামী চকিত হইয়া কহিলেন, “বিবাহের কথা কে বলিতেছে।” পিসিমা কহিলেন, “ওমা, বিবাহ না করিলে ভদ্রঘরের মেয়ে কি তোমার ঘরে অমনি আসিয়া পড়িয়া থাকিবে ।” কথাটা সংগত বটে এবং স্বামী তাহার কোনো সদুত্তর দিতে পারিলেন না । আমার রুদ্ধ চক্ষুর অনন্ত অন্ধকারের মধ্যে আমি একলা দাড়াইয়া উর্ধর্বমুখে ডাকিতে লাগিলাম, “ভগবান আমার স্বামীকে রক্ষা করো ।” তাহার দিনকয়েক “পরে একদিন সকালবেলায় আমার পূজা-আহ্নিক সারিয়া বাহিরে আসিতেই পিসিমা কহিলেন, “বউমা, যে ভাসুরকির কথা বলিয়াছিলাম। সেই আমাদের হেমাঙ্গিনী আজ দেশ হইতে আসিয়াছে। হিমু, ইনি তোমার দিদি, ইহাকে প্ৰণাম করো ।” এমন সময় আমার স্বামী হঠাৎ আসিয়া যেন অপরিচিত স্ত্রীলোককে দেখিয়া ফিরিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন । পিসিমা কহিলেন, “কোথা যাস, অবিনাশ ।” স্বামী জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইনি কে ” পিসিমা কহিলেন, “এই মেয়েটিই আমার সেই ভাসুরবি হেমাঙ্গিনী ।” ইহাকে কখন আনা হইল, কে আনিল, কী বৃত্তান্ত, লইয়া আমার স্বামী বারংবার অনেক অনাবশ্যক বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিলেন । আমি মনে মনে কহিলাম, “যাহা ঘটিতেছে তাহা তো সবই বুঝিতেছি, কিন্তু ইহার উপরে আবার ছলনা আরম্ভ হইল ? লুকাচুরি, ঢাকাঢাকি, মিথ্যাকথা ! অধৰ্ম করিতে যদি হয় তো করো, সে নিজের অশান্ত প্ৰবৃত্তির জন্য, কিন্তু আমার জন্য কেন হীনতা করা । আমাকে ভুলাইবার জন্য কেন মিথ্যাচরণ ।” হেমাঙ্গিনীর হাত ধরিয়া আমি তাহাকে আমার শয়নগহে লইয়া গেলাম । তাহার মুখে গায়ে হাত বুলাইয়া তাহাকে দেখিলাম, মুখটি সুন্দর হইবে, বয়সও চোদ-পনেরোর কম হইবে না । বালিকা হঠাৎ মধুর উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল ; কহিল, “ও কী করিতেছ। আমার ভূত ঝাড়াইয়া দিবে নাকি ৷” সেই উন্মুক্ত সরল হাস্যধ্বনিতে আমাদের মাঝখানের একটা অন্ধকার মেঘ যেন একমুহুর্তে কাটিয়া গেল । আমি দক্ষিণবাহুতে তাহার কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া কহিলাম, “আমি তোমাকে দেখিতেছি, ভাই ।” বলিয়া তাহার কোমল মুখখানিতে আর-একবার হাত বুলাইলাম । “দেখিতেছি ?” বলিয়া সে আবার হাসিতে লাগিল । কহিল, “আমি কি তোমার বাগানের সিম না বেগুন যে হাত বুলাইয়া দেখিতেছ। কতবড়োটা হইয়াছি ?” তখন আমার হঠাৎ মনে হইল, আমি যে অন্ধ তাহা হেমাঙ্গিনী জানে না । কহিলাম, “বোন, আমি